শাহনাজ মুন্নী: ছেলেমেয়ে দুজনকেই বিয়ে দিয়েছেন নুরুন্নাহার বেগম। তবে প্রথমে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেই আত্মীয়তার সম্পর্কটা গড়ে তুলতে হয়েছে তাঁর। দুই পরিবারের সংস্কৃতিগত খানিকটা ভিন্নতার কারণেই সেটা খুব একটা সহজ ছিল না। নুরুন্নাহারের মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন একটু সাবেকি ধরনের, বারো মাসে তেরো পার্বণ তাদের। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে যেন ছোট না হয়, তাই মেয়ে আগে থেকেই ফোনে মাকে জানিয়ে দিত কী কী করতে হবে সেসব, যেমন, ‘মা আমার ননদের বিয়েতে কিন্তু পাথর বসানো সোনার কানের দুল দিয়ো’
বা ‘আম-কাঁঠালের মৌসুমে ফল পাঠিয়ো, শীতের সময় সাত রকমের পিঠা পাঠিয়ো’
বা ‘অমুক দিন আমার শ্বশুর-শাশুড়ির বিবাহবার্ষিকী, ফোন করতে ভুলো না’
‘তমুক দিন আমার শাশুড়ির জন্মদিন, একটা উপহার পাঠিয়ে দিয়ো’
‘ঈদের আগে আগে নিজে এসে সবাইকে নেমন্তন্ন করে যেয়ো, সবার জন্য উপহার পাঠিয়ো’—ইত্যাদি বায়না। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের মানসম্মান, সুখশান্তি আর আদরযত্ন অটুট রাখতে নির্দ্বিধায় এসব করে গেছেন নুরুন্নাহার বেগম। একটু এদিক-সেদিক হলেই মেয়েকে কথা শুনতে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির কেউ কেউ বলেছেন, ‘তোমার বাপের বাড়ির মানুষ দেখি আত্মীয়তার রীতিনীতি জানে না।’
মেয়ের বিয়ের দু-তিন বছর পর হলো ছেলের বিয়ে। আবার ছেলের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে নতুন আত্মীয়তা। এবার অবশ্য নুরুন্নাহার বেগমের অত টেনশন নেই। উল্টো বউমার বাড়ির লোকজনই এখন তার মন রাখতে ব্যস্ত। এটা-ওটা পাঠাচ্ছে, নানা রকম আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখছে। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন বলেই হয়তো নুরুন্নাহার বেগম ছেলের বউয়ের পরিবারের ওপর অতটা মানসিক চাপ তৈরি করেন না। বরং তিনি খোলা মনে ছেলের বউকে বলেই দিয়েছেন, ‘অত আনুষ্ঠানিকতার দরকার নেই বাপু, স্বাভাবিক আত্মীয়তাটুকু বজায় রাখতে যা যা দরকার, সেটুকু করলেই চলবে।’
তবে সব সময় বিষয়টি যে একরকম হয় তা-ও না।
এ ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থানও মাঝেমধ্যে একটা বড় বিষয় হিসেবে কাজ করে। যেমন বিলকিস বানুর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি পাড়াগাঁয়ে, অর্থনৈতিকভাবেও তাদের অবস্থা তেমন একটা ভালো না, মেয়ের স্বামী রফিকই তার বাবার বাড়ির সব খরচ চালান। ফলে বিলকিস বানুর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির প্রতি আলাদা করে কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে নুরুন্নাহার বেগমের মতো এত তটস্থ থাকতে হয় না। বরং মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনই বিলকিস বানুকে খানিকটা সমীহ করে চলেন। তাঁরাই চেষ্টা করেন বউমার বাপের বাড়ির লোকজনকে খুশি রাখতে।
তবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের প্রাধান্য বেশি। যে কারণে মেয়ের মায়েরা সংসার জীবনে মেয়ের ভালো-মন্দের কথা ভেবেই তাঁদের বেয়ানবাড়ির সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। আর মেয়েকে যদি যৌথ পরিবারে, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, দাপুটে শ্বশুরবাড়িতে সংসার করতে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এ ক্ষেত্রে মেয়েটির বাবার বাড়ি যদি আর্থিকভাবে অসচ্ছল হয়, যদি তারা দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে সামান্য ত্রুটি করে, তাহলে প্রায় সময়ই সে বাড়ির বউটির দুর্ভোগের পরিমাণ যায় বেড়ে।
অনেক সময় দেখা যায়, একই সঙ্গে ছেলের শ্বশুরবাড়ির আর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদরযত্ন করার ক্ষেত্রে ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়ের শ্বশুরবাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ বিষয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, একই নারী যখন শাশুড়ি থাকেন, তখন তাঁকে একরূপে দেখা যায়। আবার একই নারী যখন মায়ের ভূমিকায় থাকেন, তখন আরেক রূপে দেখা যায় তাঁকে।ঠিক না হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের যেভাবে আপ্যায়ন করেন, ছেলের বউয়ের বাড়ির লোকজনকে সেভাবে আপ্যায়ন করেন না। কখনো এটি ভেবে দেখেন না, তাঁর নিজের মেয়েও কিন্তু আরেকটি বাড়িতে একই পরিস্থিতিতে থাকতে পারে। ফলে যে ধরনের আচরণ মেয়ের শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে করছেন, একই আচরণ ছেলের শ্বশুরবাড়ির মানুষদের সঙ্গেও করা উচিত। এতে মুখে কিছু না বললেও ছেলের বউ কষ্ট পেতে পারে। এতে বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব বাড়বে।
এখন অবশ্য আগের চেয়ে সময় অনেক পাল্টেছে। এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করছেন। যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। আচার-আনুষ্ঠানিকতার কিছু রীতিনীতি অনেক খানি কমে গেছে। তার পরও দুই বেয়ানবাড়ির মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে দুই পক্ষকেই সমান সচেষ্ট থাকা দরকার।
(লেখাটি প্রথম আলো থেকে নেয়া)
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও লেখক।