
সালেহ্ বিপ্লব: চন্দ্রমুখীর বাবা কাঁদছেন। সন্তানহারা মাতা-পিতার যন্ত্রণা, কষ্ট, হাহাকার মুকুলের ফেসবুক পাতায়। যে যন্ত্রণা বোঝার সাধ্য কারো নেই, কোন ব্যারোমিটারে মাপা যায় না সে শোকের তীব্রতা। কাঁদলে নাকি কষ্টের বোঝা হালকা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি পিতার কাঁধে সন্তানের মৃতদেহ। সেই দুঃসহ বোঝা কাঁধে নিয়েছেন মুকুল, আমরণ কান্নাও সে ভার তিলমাত্র হালকা করতে পারে না।
শোকের প্রাথমিক ধাক্কা কাটলে নজর পড়ে চারপাশে। কিন্তু চারপাশে কোথায় তাকাবেন মুকুল-নাজনীন? যেদিকে তাকান সেদিকেই খলবলিয়ে হেসে ওঠে চন্দ্রমুখী। পাগলপারা হয়ে বাবা হাত বাড়ান, বুকে জড়িয়ে নিতে যান! হায়রে, সে তো আর ধরা দেয় না! চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় মুকুলের জগৎ-সংসার। পুরো ঘরে চন্দ্রমুখীর ছাপ। ঘরের বাতাসে ভাসে কচিকণ্ঠের মিষ্টি কথামালা। হয়তো স্মৃতির একরাশ মেঘ আঁকড়ে ধরতে গিয়ে চন্দ্রমুখীর আঁকা ছবি বুকে চেপে ধরেছেন সন্তানহারা পিতা, কচি হাতে আঁকা বাবার ছবি।
১৮ তারিখ পার হয়ে ঘড়ির কাঁটায় তখন ১৯ সেপ্টেম্বর। রাত তিনটার কিছু আগে ফেসবুকে এলেন মুকুল। চন্দ্রমুখীর আঁকা ‘বাবার’ ছবি আপ করলেন।
শোকাচ্ছন্ন পিতা লিখলেন, “পৃথিবীর আর কোন বিখ্যাত শিল্পী কি পারবে এমন করে বাবার ছবি আকতে ? আমি জানি পারবেনা .. শুধু আমার চন্দ্রমুখী যোগ্যতা রাখে এমন হৃদয় দিয়ে বাবার প্রতিকৃতি আকার .. বড় অন্ধকার এক পৃথিবীতে দিশেহারা বাবাকে ফেলেকোথায় টুকি দিলে মিম্মি…আমার যে আর কোনো আলো নেই .. হাসি নেই…নেই বেচে থাকার পাথেয় টুকুও..নক্ষত্রের মাঝে, ক্ষয়ে যাওয়া চাদের মিষ্টি আলোয় যে খুঁজে ফিরি .. যেখানে থেকো বাবা প্রতিদিনের মত ঘুম পারবো তোমায়.. রাত গভীর হলে ফিডি নিয়ে অপেক্ষায় থাকব তোমার .. এসে বল ” বাবা ফিডি দাওনা.. ৫ তা খাব. “. এই অপেক্ষা আজীবনের..বাবাকে ক্ষমা কর চন্দ্রমুখী মা আমার..যখন বড্ড একা লাগবে ..ছুটে এস ক্ষতবিক্ষত এই নিঃস বুকে ..আগের মত জড়িয়ে মিষ্টি করে বল ” ঘুমবো ” …অপেক্ষায় আছি. .এই মধুর ডাকটা শুনব বলে …”
সেই ডাক আর কি শোনা যাবে ধরার ধরণীতে?
১৪ সেপ্টেম্বর চন্দ্রমুখীর অসুস্থতার কথা ছিলো মুকুলের ফেসবুক স্ট্যাটাসে। লিখেছিলেন, “এই পৃথিবীতে যাকে সবচে বেশি ভালবাসি সেই চন্দ্রমুখী এখন আইসিউতে লাইফসাপোর্ট-এ .. ওর প্রত্যেকটা কষ্ট দিগুণ হয়ে ফিরে আসছে আমার বুকে .. আমি যে বাবা .. সবার কাছে মন থেকে দোআ ভিক্ষাচাই আল্লাহ যেন চন্দ্রমুখীকে আমার কোলে ফিরিয়ে দেন।”
নিয়তির গতি পরিবর্তন হয়নি, বিধাতা নিয়ে গেছেন ছোট্ট ফুলকে তার নিজের বাগানে। এরপর নাজনীন তন্বী পাঁচতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে শোক ও বেদনার বোঝা আরো ভারি করলেন। সন্তানহারা মুকুল কী করে সময় পার করছেন, ভাষা তা প্রকাশ করার সামর্থ্য রাখে না।
চন্দ্রমুখীর মা, জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার নাজনীন তন্বী এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ-তে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর পরিবর্তন ডটকম-কে জানান, “নাজনীনের স্পাইনাল কর্ডের আঘাতটা গুরুতর। তার আরো একাধিক অপারেশন লাগতে পারে।”
মুকুল-নাজনীন স্মৃতির দহন থেকে বাঁচবেন কী করে? হঠাৎ করে রাস্তায় কোন বাচ্চার দিকে চোখ পড়বে, মনে পড়বে চন্দ্রমুখীর কথা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাত বাড়াবেন, সে হাতে ধরা দেবে না প্রাণপ্রিয় মেয়েটি। কোন খাবার দেখলে চট করে মনে পড়বে, চন্দ্রমুখীর প্রিয় খাবার ছিলো সেটি। বাজারে যাবেন, বাচ্চাদের কাপড়ের দোকান পার হতে গিয়ে অজান্তেই থমকে দাঁড়াবেন, চোখে জল গড়াবে মেয়ের প্রিয় রঙের কোন ড্রেস দেখে। এমনই হয়। কষ্টের একরাশ ধোঁয়াশা তাদের জীবন স্থায়ী হয়ে গেল, এটা মেনে নিয়েই পথ চলতে হবে।
“আপনি কাঁদবেন না, মুকুল”। মুকুলের বন্ধু, দীর্ঘদিনের মাঠের সহকর্মীরা যতো বার একথা বলতে চান, ততোবারই কান্না তাদেরও আচ্ছন্ন করে ফেলে। বন্ধু-সুহৃদ সবার প্রার্থনা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ মুকুল-নাজনীনকে শোক সহ্য করার শক্তি দিন। সাংবাদিকদের প্রিয় নাজনীন ভাবীকে সুস্থ করে তুলুন। আবার জীবনের স্রোতে, জীবনের গতিতে পথচলা শুরু হোক তাদের। শুভাকাঙ্খীদের উত্তোলিত হাত সৃষ্টিকর্তার দরবারে চন্দ্রমুখীর জন্য প্রার্থনা করছে, প্রার্থনা মুকুল-তন্বীর জন্যে।
লেখক পরিচিতি: বার্তা সম্পাদক, পরিবর্তন ডটকম
(লেখাটি পরিবর্তন ডটকম থেকে নেয়া)