পোশাক শ্রমিকদের কথা শুনছে না কেউ

Garment workerসুপ্রীতি ধর (১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩): রানা প্লাজা ধসের পর সেখানকার আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সাথে যতো মিশছি, ততোই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ওরা ওদের অধিকার সম্পর্কে বেশ সচেতন। ওরা জানে, ওদের কাজ কি? আর প্রাপ্যই বা কতটুকু? নিজেদের প্রাপ্যের বাইরে তাদের বিন্দুমাত্র দাবি নেই। ওরা চায় সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর একটু স্বস্তি, একটু নিরাপত্তা। জীবনের আয়েশ তারা পাবে না জেনেই জন্ম নিয়েছে, তাই তাদের ঘামের বিনিময়ে যারা আয়েশি জীবনটা যাপন করে, তাদের প্রতি তাদের আগ্রহ নেহায়েতই কম। এটাও জানে, কষ্ট করতে হলে পুষ্টির প্রয়োজন, যেমন নিজেদের, তেমনি তাদের সন্তানদেরও। সেই পুষ্টি তারা পাবে কোথায়? নুন আনতে পান্তা ফুরায় যে সংসারে, সেখানে আবার পুষ্টি!

এই পোশাক শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন চালিয়ে গেলেও তাদের দাবি দাবিই থেকে যাচ্ছে শেষপর্যন্ত। গত কয়েকদিনের জেনেভা বৈঠক এবং বৃহস্পতিবারের বিজিএমইএ নেতাদের বৈঠকেই এর মূলসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। মজুরি মাত্র ১৯ বা ২০ শতাংশ বাড়াতে রাজী হয়েছে মালিকপক্ষ। আর এ হলে এই হিসাবে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি দাঁড়াবে তিন হাজার ৫৭০ বা তিন হাজার ৬০০ টাকা। একথা মালিকপক্ষ জানিয়েছেন বৃহস্পতিবার। অন্যদিকে জেনেভায় শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকে তারা অনুপস্থিতি থাকায় মোটামুটি কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই সেই বৈঠক শেষ হয়েছে। বলা যায়, বৈঠকটি ব্যর্থ হয়েছে।

মালিকদের বক্তব্য,  মজুরি ২০ শতাংশের বেশি বাড়ালে অনেক মালিকই টিকে থাকতে পারবেন না। তাছাড়া তাদের আরও কারণ আছে। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা আগের চেয়ে কম দামে অর্ডার দিচ্ছেন। আবার তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজা ধসের পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করতে তাঁদের বহু টাকা খরচ করতে হচ্ছে বলেও তারা দাবি করেন।

বিজিএমইএ কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন পোশাক কারখানার মালিকেরা। উল্লেখ্য, গত জুনে পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে ছয় সদস্যের মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। গত ১৮ আগস্ট বোর্ডের তৃতীয় সভায় শ্রমিক প্রতিনিধির পক্ষ থেকে নিম্নতম মজুরি আট হাজার ১১৪ টাকা দাবি করা হয়। এর মধ্যে মাসিক মূল মজুরি ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৩৪, বাড়িভাড়া এক হাজার ৭৮০ (মূল মজুরির ৩০ শতাংশ) ও মাসিক চিকিৎসা ভাতা ৪০০ টাকা। এ ছাড়া যাতায়াত, হাজিরা ও খাদ্য ভাতা নিম্নতম মজুরির অতিরিক্ত হিসেবে দিতে হবে।

২ সেপ্টেম্বর মজুরি বোর্ডের চতুর্থ সভায় মালিকপক্ষের পাল্টা প্রস্তাব দেওয়ার কথা থাকলেও লিখিত আবেদন করে বিজিএমইএ দুই সপ্তাহের সময় চায়। বোর্ড সদস্যদের সম্মতিক্রমে চেয়ারম্যান এ কে রায় বিজিএমইএকে সময় দেন। সমিতিকে ১৭ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সভায় প্রস্তাব দিতে বলা হয়।

গতকালের বৈঠকটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মালিকপক্ষ সবাই একমত হয়েছেন একটি ব্যাপারে যে, আবেগের বশবর্তী হয়ে তড়িঘড়ি করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।  তাদের মতে, রানা প্লাজা ধসের পর দেশের পোশাক খাতের ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। তাই কোন আবেগ নয়। ভাল কথা। আবেগ না হয় নাই হলো, তাই বলে একজন শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ন্যূনতম মূল্যও দেওয়া যাবে না? দীর্ঘদিন ধরে তারা যে মানুষের মতো বাঁচার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাও কি মানবার নয়?

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে মালিকপক্ষের একপেশে কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাদের লোকসান, তাদের সক্ষমতা, বিদেশি ক্রেতাদের কমমূল্যে অর্ডার এসব কথাই ঘুরেফিরে উঠে এসেছে। অনুচ্চারিত রয়ে গেছে শ্রমিকদের রক্তঘাম করা পরিশ্রমের কথা, অপুষ্টি-নি:স্ব জীবনযাপনের কথা, প্রতিটি শ্রমিকের একটা করে গল্প আছে, সেই গল্পগুলো বার বার বলা হলেও যাদের শোনার কথা তাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না, বা বলা ভাল, পৌঁছালেও জায়গামতো স্পর্শ করতে পারছে না।

তাদের অনেকেই বলছেন, মজুরি বাড়ানোর কী আছে? মজুরি তো ভালই পায় শ্রমিকেরা। পোশাকশ্রমিকদের মজুরির বর্তমান কাঠামোতে মোট সাতটি গ্রেড আছে। বেশির ভাগ পোশাক কারখানায় শ্রমিকেরা সর্বনিম্ন মজুরির চেয়ে বেশি বেতন পান। ২ নম্বর গ্রেডের শ্রমিকেরা ৯১ শতাংশ ও ৩ নম্বর গ্রেডের শ্রমিকেরা ১১১ শতাংশের বেশি মজুরি পান।

নিজেদের ঘাটতির কথাও তারা বড়মুখ করেই বলেন, বলেন লোকসানের কথা। তাই তারা ১৯ শতাংশের বেশি বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই বলে মত প্রকাশ করেছেন।

এসব দেখে-শুনে-পড়ে আমার কেবল লতা-আফরোজাদের কথাই মনে পড়ে। ওরা কত আশা করে ঢাকা থেকে যাওয়া মানুষগুলোর কথা শুনতে আসে। কিন্তু বার বারই কিছু সান্ত্বনার কথা ছাড়া কিছুই মেলে না তাদের।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.