তানিয়া মোর্শেদ: আমি একটি “উপহার” নিয়ে জন্মেছি (আমাকে কিছুই করতে হয়নি এরজন্য!), যখন একজন মানুষকে দেখি, আমি শুধুই মানুষ দেখি। এর বেশী কিছুও নয়, এর থেকে কম কিছুও নয়। গতরাতের এক আড্ডায় ধর্ম, মানুষের আচরণ ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমাকে শুনতে হলো যে, মানুষ বেশী অনুভব করে এবং চেষ্টা করে কিছু করবার যখন অসহায় মানুষ/মানুষটি তার স্বগোত্রীয় হয় (একই বর্ণ/দেশ/ধর্ম (বেশীর ভাগের জন্য স্বধর্ম)।
আমি তা মানি না। আমাকে উদাহরণ হিসাবে বলা হলো যে, একজন ক্ষুধার্ত বাংলাদেশী শিশু আর একজন ক্ষুধার্ত আফ্রিকার শিশুর মধ্যে আমি না কি বাংলাদেশী শিশুটির মধ্যে নিজের সন্তানের মুখ বেশী দেখবো! কোনো ভাবেই তা মানি না। আমার অনুভূতি সবার জন্যই সমান। আমার সাধ্য কম বলে শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু করবার চেষ্টা করছি। আমার সাধ্য থাকলে সবার জন্য, যে কোনো দেশের মানুষের জন্যই আরও করতাম। আমার অনুভূতি সবার জন্য সমান কিন্তু আমার কাজ সব দেশের জন্য এক নয় (বাধ্য হয়েই)।
আমি নিজেকে এক স্বাচ্ছন্দ্যের বলয়ে (কমফোর্ট জোন) এ রেখে ভাবি যে, অন্য মানুষ আছে যারা অন্য দেশের মানুষের জন্য করবে/করছে আর অপরাধবোধে ভুগি। আমি বলেছিলাম যে, আমি যখন মারিয়ার ঘটনা জেনেছিলাম তখন একই অনুভূতি হয়েছিল যা হয় একজন বাংলাদেশী নারীর ঘটনা শুনলে। আমাকে অনেক উদাহরণ দেওয়া হলো। আমিও অনেক উদাহরণ দিয়েছি!
আমার দু’ বৎসর বয়স থেকে আমার মা চাকরি করতেন। করতেন বলছি কারণ গত বৎসর তিনি অবসর নিয়েছেন। দীর্ঘ দীর্ঘকাল তাঁর কর্ম জীবন। সেই সময় বাংলাদেশে কোনো ডে-কেয়ার ছিল না। আমার মা’র কাজের ধরনটাই এমনই ছিল যে, দিনের লম্বা সময় তাঁকে পাইনি। আরও একটু বড় হবার পর অনেক (বেশীর ভাগ) সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। সেই দু’ /আড়াই বৎসর বয়স থেকে অনেক সময় কেটেছে গৃহকর্মীর কাছে। খুব ভালবাসতেন আমায়, আব্বাসের মা। হ্যাঁ তাঁর নাম জানি না। বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ী নিম্নবিত্তের নারীদের পরিচয় কারো মা হিসাবেই, সন্তান না থাকলেও নিজের নাম দিয়ে নয়, অন্য কিছু দিয়ে ডাকা হয়।
পাশের বাড়ির খোকন আর দীপনের মাঝখানে আমি, বয়সানুযায়ী। ছন্দা কাকীমা আমায় কি যে ভালবাসতেন! কত দুপুর গেছে কাকীমা আমাদের তিনজনকে এক সাথে ভাত খেতে দিয়েছেন। বাবা ডিপার্মেন্ট থেকে ফিরে গৃহকর্মীকে দিয়ে ডেকেই চলেছেন! আমি কি আর বন্ধুদের ছেড়ে বাড়ি যাই! দুপুরের খাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কাকীমা কি না খাইয়ে রাখবেন? খাওয়া দাওয়ার পর কত দুপুর কেটেছে কাকা, কাকীর মাঝখানে একপাশে দীপন আর একপাশে খোকন মাঝে আমি! ঘুমানোর ভান করতে করতে ফিসফিসানি! বাড়ি ফিরে বাবার বকা খেলেও একই ঘটনা ঘটেই চলতো।
যখন আরেকটু বড় হয়ে গেলাম, পুতুল- হাঁড়ি পাতিল নিয়ে খেলা শুরু করলাম তখন শাওন-নিক্কনদের বাড়িতে প্রায় একই ধরনের ঘটনা শুরু হলো। আমার ভাইদের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান কিছুটা বেশী হওয়ায় এক সন্তান ছিলাম যতদিন, এসব ঘটনা তখনকার। জীবনে কখনো ভাবিনি খোকন-দীপন আর আমার মাঝে পার্থক্য কি। হ্যাঁ কিছুটা বড় হয়ে বুঝেছি ওরা ছেলে আর আমি মেয়ে। হ্যাঁ এক সময় সমাজ বুঝিয়েছে যে, জন্মগত কারণে ওদের ধর্ম আমার থেকে আলাদা। ব্যাস এটুকুই। এ নিয়ে কোনো চিন্তা করবার কিছুই ছিল না, আজো নেই। পরবর্তীতে শ্যামলী-রমার সাথে বন্ধুত্বের মধ্যে আর শাওন-সুস্মির সাথে বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মাথায় কখনো আসেনি জাপানের দেড় বৎসরের জীবনে বন্ধু বলতেই মাধব’দার ধর্ম কী (আজও যোগাযোগ আছে)।
এখানে প্রথম জীবন পার্ডু ইউনিভার্সিটিতে সুকমল’দা আর পিংকুর ধর্ম কী! আজো যোগাযোগ আছে, শুধুই তাঁদের সাথে। বাকীরা অতীত হয়েছেন, স্বেচ্ছায়।
মিজানের দুই বেস্ট ফ্রেন্ড প্রণব’দা আর পূর্ণেন্দু’দার ধর্ম কী! দীপ্ত’র বেস্ট ফ্রেন্ড অর্ণবের ধর্ম কী! আমাকে এক সময় “মা” বলে ডাকা অত্রীর ধর্ম কী!! সবিতার ধর্ম কী! রীতুর ধর্ম কী! সুপ্রীতির ধর্ম কী!
মনটা ব্যথায় ভরে আছে। দু’দিন আগেই ফেইসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখেছি যে, ১৯৭১-এ নিহত/ নিখোঁজ হিন্দু ধর্মাম্বলীদের জন্য গণ শ্রাদ্ধের আয়োজন হচ্ছে, ৪ঠা অক্টোবর। এনিয়ে একজনের সাথে বেশ কথা চলেছে সেখানে। আমি জানি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের (যে কারণেই সংখ্যালঘু হোন না কেন (দুঃখিত অপছন্দের শব্দটি ব্যবহারের জন্য)) কী অবস্থা! আমাকে এ বিষয়ে কারো কিছু বলতে হবে না। দুঃখ পেয়েছি বেশী যখন দেখলাম যার সাথে তর্ক হচ্ছে তিনি একজন লেখক। আমার ধারণা লেখকদের চিন্তা-ভাবনা-দেখা সাধারণ মানুষদের থেকে উচ্চ মানের হয়। কিছুদিন ধরে অবশ্য এবিষয়ে সংশয় শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বৈষম্য চরম রুপ নিয়েছে, সব জায়গায়। ধর্মান্ধদেরই শক্তি বেশী। তবুও আজ পর্যন্ত দেখিনি শহীদদের ধর্ম নিয়ে কোথাও কেউ প্রশ্ন তুলেছে। মানে শহীদদের কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে অন্যান্য ধর্মের বা নাস্তিক ইত্যাদি। আমার জানা নেই কোনো গণ জানাজা বা মিলাদ বা অন্য কিছু হয়েছে কিনা। মিলাদ অবশ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতির অংশ। এটা অন্য দেশের মুসমানরা করে না, আমার অল্প জানা তাই বলে। শহীদদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে, হয়। যা আমাদের সবার উচিৎ প্রতিহত করা। তবে এই প্রথম তাঁদের নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা শুনছি। এর পেছনে কারা আছে তা নিয়ে ইতিমধ্যে কথা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য যারা এসব করছে তাদের এখনি প্রতিহত না করলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এখনো যা আছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে।
মানুষ সামনের দিকে হাঁটে, পেছনে নয়। ১৯৭১-এ যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল তা আজ নেই। কেন নেই, কাদের জন্য নেই তা সুস্থ ভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায়। পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও বাড়াতে হবে, ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া শেখাতে হবে। এ সময় ধর্মকে ব্যবহার করে কাউকে ফায়দা লুটতে দেওয়া যাবে না। যতই আপাত নিরীহ মনে হোক না কারো কারো কাছে, এই গণ শ্রাদ্ধের আয়োজন ধর্ম ব্যবসায়ীদেরই এক কূট চাল। কোনো শহীদ, কোনো মুক্তিযোদ্ধা ধর্মের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ করেননি। স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছে বাঙালী চেতনার জন্য, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।