যৌন নিপীড়নের ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সুনামি: ভেতরের ঝড়

সুমিত রায়:

এটিই সম্ভবত যৌন নিপীড়নের সবচেয়ে মারাত্মক এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। প্রতিনিয়ত অপমান, ভয়, উদ্বেগ এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করতে করতে একজন মানুষের মানসিক জগৎটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কর্মস্থল, যা একসময় তার স্বপ্ন পূরণের জায়গা ছিল, তা পরিণত হয় একটি মানসিক নির্যাতন কেন্দ্রে।

দুশ্চিন্তা এবং বিষণ্ণতা (Anxiety and Depression): ভুক্তভোগীরা প্রায়ই তীব্র এবং সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এই অবস্থাকে ‘Anticipatory Anxiety’ বা ‘প্রত্যাশিত দুশ্চিন্তা’ বলা যেতে পারে, যেখানে আসল ঘটনার চেয়ে ঘটনা ঘটার ভয়টাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই অফিসে যাওয়ার ভয়ে বুক কাঁপা শুরু হয়। প্রতিটি ই-মেইল নোটিফিকেশন, বসের রুম থেকে আসা প্রতিটি ডাক, বা করিডোরে নিপীড়কের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা – এই সবকিছুই তাদের মনে তীব্র আতঙ্ক তৈরি করে। কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, সামান্য শব্দে চমকে ওঠা, ঘুমের সমস্যা (ইনসমনিয়া বা দুঃস্বপ্ন), এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া – এগুলো দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যায়। এই দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ধীরে ধীরে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে (Clinical Depression) রূপ নিতে পারে। ভুক্তভোগী তার পছন্দের বা আনন্দদায়ক কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, নিজেকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন, এবং ‘Learned Helplessness’ বা ‘অর্জিত অসহায়ত্ব’-এর শিকার হন – অর্থাৎ, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে পরিস্থিতি বদলানোর কোনো ক্ষমতা তার নেই। নিজেকে তিনি সম্পূর্ণ মূল্যহীন ভাবতে শুরু করেন এবং অনেক সময় আত্মহত্যার মতো চরম চিন্তাও তাদের মাথায় আসতে পারে।

পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (Post-Traumatic Stress Disorder – PTSD): তীব্র যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেখানে শারীরিক আক্রমণ বা ধর্ষণের চেষ্টা জড়িত থাকে, ভুক্তভোগীর মধ্যে পিটিএসডি-র লক্ষণ দেখা যেতে পারে। তবে কর্মক্ষেত্রে যখন নিপীড়ন দীর্ঘ সময় ধরে এবং বারবার ঘটতে থাকে, তখন তা আরও জটিল রূপ নিতে পারে, যাকে মনোবিজ্ঞানী জুডিথ হারম্যান (Judith Herman) তার যুগান্তকারী বই Trauma and Recovery-তে ‘কমপ্লেক্স পিটিএসডি’ (Complex PTSD) হিসেবে অভিহিত করেছেন। এক্ষেত্রে কেবল একটি ঘটনার স্মৃতি নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী নির্যাতনের কারণে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিত্ব এবং সম্পর্ক তৈরির ক্ষমতাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় (Herman, 1992)। ঘটনার বেদনাদায়ক স্মৃতি বা ফ্ল্যাশব্যাক বারবার ফিরে আসা, দুঃস্বপ্ন দেখা, এবং নিপীড়নের স্থান (যেমন – লিফট, কনফারেন্স রুম) বা ব্যক্তির মুখোমুখি হতে তীব্র ভয় পাওয়া – এই সবই এর লক্ষণ। ভুক্তভোগী ‘হাইপারভিজিলেন্স’ (Hypervigilance) বা অতি-সতর্ক অবস্থায় চলে যান। অফিসের প্রতিটি কোণ তার কাছে অনিরাপদ মনে হয়। প্রতিটি পায়ের শব্দ, প্রতিটি অপ্রত্যাশিত স্পর্শ (এমনকি নির্দোষ হলেও) তার শরীর ও মনে তীব্র ভীতির সঞ্চার করে। এমনকি সাধারণ কোনো পারফিউমের গন্ধ বা কোনো নির্দিষ্ট শব্দও তার সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
আত্মমর্যাদার অবক্ষয় এবং আত্ম-দোষারোপ: নিপীড়নের শিকার হতে হতে ভুক্তভোগীর আত্মবিশ্বাস এবং আত্মমর্যাদা (self-esteem) পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। সে নিজেকে দুর্বল, অযোগ্য এবং মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে। সমাজের দোষারোপের সংস্কৃতির কারণে এবং অনেক সময় নিপীড়কের সুচতুর ম্যানিপুলেশনের কারণে সে নিজেকেই দায়ী করতে থাকে, যা তার মানসিক যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেয়। “আমার মধ্যেই হয়তো কোনো সমস্যা আছে,” “আমার পোশাকটা কি ঠিক ছিল না?”, “আমারই হয়তো প্রতিবাদ করা উচিত ছিল” – এই ধরনের আত্ম-দোষারোপের চিন্তা তাকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। এই লজ্জা এবং অপরাধবোধ তাকে মুখ খুলতে বাধা দেয় এবং একাকীত্বের অন্ধকারে ঠেলে দেয়।

বিশ্বাসহীনতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: এই অভিজ্ঞতা মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। ভুক্তভোগী কেবল নিপীড়ককে নয়, বরং সহকর্মী, ব্যবস্থাপক, এমনকি প্রতিষ্ঠানের উপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। সে ভাবতে শুরু করে, “কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না,” বা “অভিযোগ করলে সবাই আমাকেই খারাপ ভাববে।” এই ভয় থেকে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, সহকর্মীদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়, যা তাকে কর্মক্ষেত্রে আরও একাকী এবং অসহায় করে তোলে। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
গ্যাসলাইটিং-এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব: গ্যাসলাইটিং-এর শিকার হতে হতে ভুক্তভোগী নিজের স্মৃতি, অনুভূতি এবং বাস্তবতার বোধের উপরই সন্দেহ করতে শুরু করে। যখন নিপীড়ক বা প্রতিষ্ঠানের অন্যরা বারবার বলে, “তুমি বেশি ভাবছ,” “এটা তো একটা নির্দোষ মজা ছিল,” বা “তুমি বেশি সেনসিটিভ,” তখন ভুক্তভোগী সত্যিই ভাবতে শুরু করে যে সমস্যাটা হয়তো তারই। “আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?” – এই প্রশ্নটি তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে তার আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শেয়ার করুন: