ফারদিন ফেরদৌস:
মানব সভ্যতার ইতিহাসে নারী-পুরুষের সহাবস্থান চিরকালীন সত্য। তবু এক পক্ষ তার আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে অপর পক্ষকে অবদমিত রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেছে। এই সহিংসতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নারীরা লড়াই করে আসছেন। সমাজের তথাকথিত সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী দয়া পরবশ হয়ে নারীর জন্য একটি মাত্র দিবস নির্ধারণ করে দিয়েছে, অথচ প্রশ্ন থেকে যায়—পুরুষের জন্য কি কোনো আলাদা দিবস আছে?
নারী দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা কি আসলে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করছি, নাকি নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিচ্ছি? একজন নারীর জন্য শুধুমাত্র একটি দিন বরাদ্দ করে বাকি ৩৬৪ দিন পুরুষের জন্য রেখে দেওয়া চরম বৈষম্য নয় কি? নারীর অধিকার, মর্যাদা এবং সমানাধিকারের প্রশ্ন কোনো এক দিনের আলোচনার বিষয় হতে পারে না। বরং এটি প্রতিদিনের সংগ্রাম, প্রতিদিনের দাবি।
পিতৃতন্ত্রের নির্মম বাস্তবতা আমরা সবাই দেখে চলেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে নারীর প্রতি অবিচার নতুন কিছু নয়। বেগম রোকেয়া তাঁর “নারীবাদ” গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে সমাজ নারীদের জন্য আলাদা নিয়ম তৈরি করেছে, তাদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এবং তাদের কেবল গৃহস্থালির শ্রমে আবদ্ধ রেখেছে। তাঁর দৃষ্টিতে, নারীর অবদমন কেবল পুরুষের শক্তি প্রয়োগের ফল নয়, বরং এটি সমাজের গঠনগত এক জটিল ব্যবস্থার অংশ, যেখানে নারী নিজেও অনিচ্ছাকৃতভাবে বন্দিত্বকে মেনে নেয়।
এই সামাজিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন সিমোন দ্য বোভোয়ার তাঁর “The Second Sex” বইয়ে। তিনি বলেছিলেন, “নারী জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে”, অর্থাৎ সমাজই নারীর অবস্থানকে সংজ্ঞায়িত করে এবং তাকে বাধ্য করে নির্দিষ্ট একটি ভূমিকা পালন করতে। জন্ম থেকেই পুরুষকে সক্রিয় ও প্রভাবশালী হিসেবে গড়ে তোলা হয়, আর নারীকে শিখিয়ে দেওয়া হয় কীভাবে বিনয়ী, অনুগত ও আত্মত্যাগী হতে হয়। এই কৃত্রিম বিভাজনই সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যের মূল ভিত্তি।
নারী কেন পিছিয়ে থাকবে? নারীর প্রতি বৈষম্য কেবল সামাজিক রীতি বা প্রচলিত ধ্যানধারণায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। আজও নারী কেন—
• উন্মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে ভয় পায়?
• উচ্চস্বরে কথা বলতে সংকোচ বোধ করে?
• নিজের ইচ্ছায় পথ চলতে পারে না?
• সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়?
• ধর্মীয় অনুশাসন, নীতিশাস্ত্র ও সামাজিক বিধিনিষেধের নামে দমনের শিকার হয়?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে বোঝা যায়, নারী কেবল পুরুষের করুণা বা দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়; বরং নারী নিজেই তার অস্তিত্বের পূর্ণতা দাবি করতে পারে। ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর “A Room of One’s Own” বইয়ে বলেছিলেন, নারী যদি সত্যিই নিজের সৃষ্টিশীলতা ও স্বাধীনতা প্রকাশ করতে চায়, তবে তার প্রয়োজন স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং নিজস্ব চিন্তার জায়গা। কিন্তু সমাজ তাকে সেই জায়গা দিতেও কুণ্ঠিত।
আমাদের সবাইকে মানতে হবে নারীর স্বাধীনতা মানেই মানবজাতির মুক্তি। নারীর মুক্তি ও অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে শুধুমাত্র নারীবাদী লড়াই হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি মানবতার মুক্তির আন্দোলন। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “নারী” কবিতায় নারীর অবদমনের বিরুদ্ধে যে উচ্চারণ করেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক:
“নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা অই কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।”
এখানে কবি নজরুল ভবিষ্যতের সেই চিত্র এঁকেছেন, যেখানে নারীর অবদমন শেষ পর্যন্ত পুরুষকেই কষ্ট দেবে। নারীর প্রতি অবিচার সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে, অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে। তাই নারীর স্বাধীনতা মানে কেবল নারীর মুক্তি নয়, বরং গোটা মানব জাতির মুক্তি।
বেল হুকস তাঁর “Feminism Is for Everybody” বইয়ে দেখিয়েছেন, নারীবাদ শুধুমাত্র নারীদের নয়, বরং সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মুক্তির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পিতৃতন্ত্র পুরুষদেরও শৃঙ্খলিত করে রাখে—তাদের সংবেদনশীলতা, অনুভূতি প্রকাশের স্বাধীনতা এবং পরিচয়ের বহুমাত্রিকতা কেড়ে নেয়। তাই নারীর মুক্তি মানেই কেবল নারীর জয় নয়, বরং এটি মানবতার জয়।
নারী দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত অর্থে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। কীভাবে?
• প্রতিবাদ ও সচেতনতা: যে কোনো ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নারীর প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
• শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান মাধ্যম শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। প্রতিটি নারীকে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে।
• আইন প্রয়োগ ও নীতি সংস্কার: নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
• মানসিকতার পরিবর্তন: পিতৃতন্ত্রের চক্র ভেঙে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
নারী দিবস কেবল এক দিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি প্রতিদিনের চেতনার বিষয়। সমাজে সত্যিকারের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে আর কোনো নারীকে বিশেষ দিবসের প্রয়োজন হবে না। সকল দিন হবে নারী-পুরুষের, সকল দিন হবে মানুষের। এক দফা, এক দাবি— লৈঙ্গিক রাজনীতির চির অবসান হোক!
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
• বেগম রোকেয়া, “নারীবাদ”
• Simone de Beauvoir, “The Second Sex”
• Virginia Woolf, “A Room of One’s Own”
• bell hooks, “Feminism Is for Everybody: Passionate Politics”
• কাজী নজরুল ইসলাম, “নারী”
লেখক: সাংবাদিক
৮ মার্চ ২০২৫