ফারদিন ফেরদৌস:
আমরা শত ফোরামে অনেকবার বলেছি, নারীর প্রতি সহিংসতা সভ্যতার অভিশাপ, মায়েরা জিতলে জয়ী হয় মানুষ। কিন্তু মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের এই জমানায় কাপুরুষেরা নারীর অধিকার ও সম্মান নিয়ে যাচ্ছেতাই কারবার করেই যাচ্ছে।
এবার কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তরুণ চিকিৎসক মৌমিতা দেবনাথকে ওই কলেজেই ধর্ষণ করে হত্যা করেছে তাঁর চেনা মানুষেরা। নারীর প্রতি সহিংসতায় পৃথিবীতে ঘৃণ্য অভিশাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ন্যাক্কারজনক এই ঘটনার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, পুরো ভারতবর্ষ এখন উত্তাল। বোধ ও বিবেকসম্পন্ন মানুষেরা প্রতিবাদ করছে।
ইন্ডিয়ান চিকিৎসকদের সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব রেসিডেন্ট ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (ফোরডা) হাসপাতালগুলোতে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে।
তবে যথারীতি রাজনীতিক ও তাদের পোষ্য আইন প্রয়োগকারীরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে নানান বাহানা ও কারসাজি করে চলেছে। প্রথমে আত্মহত্যার ঘটনা বলে প্রমাণ করতে চায় তারা। বিক্ষোভকারীদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হচ্ছে।
দ্য ডেইলি স্টার লিখেছে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সোদপুরে থাকতেন ওই নারী চিকিৎসক। মা–বাবার একমাত্র সন্তান ওই চিকিৎসক এমবিবিএস শেষে আর জি কর মেডিকেল কলেজে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করছিলেন। ছিলেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গত বৃহস্পতিবার রাতে ট্রেইনি চিকিৎসক হিসেবে হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। রাত দুইটায় আরও চারজন চিকিৎসক বন্ধুর সঙ্গে তিনি রাতের খাবার খান। এরপর চারতলার একটি কক্ষে বিশ্রাম নিতে যান। পরদিন সকালে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে পুলিশ ইতোমধ্যে সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করেছে। সিসিটিভির ফুটেজ ও ঘটনাস্থলে পাওয়া তার হেডফোন থেকে পুলিশ সঞ্জয়কে চিহ্নিত করে ও গ্রেপ্তার করে। ঘটনার রাতে সে আরজি কর হাসপাতালে অবস্থান করছিল। বাইরে থেকে মদ পান করে গভীর রাতে সে হাসপাতালে প্রবেশ করে এবং সেমিনার হলে চলে যায়। সেখানেই সে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা করে বলে অভিযোগ।
সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে জানা যাচ্ছে, মৌমিতাকে যখন gang despoil করা হয়, সেসময় দুই পাশ থেকে দুইজন ওর হাত চেপে ধরে রাখে। এর মধ্যে একজন মৌমিতারই ফিমেল কলিগ, যিনি আবার মৌমিতার আরেক ইন্টার্ন কলিগের গার্লফ্রেন্ড। ওই ঘটনা ঘটার আগে মৌমিতা সেই মেয়েটার সঙ্গে একসাথে বসে ডিনারও করেছে! এই তথ্য যদি সত্যি হয়, তবে মানুষ আর কাকে বিশ্বাস করবে?
পিতৃতন্ত্র হাজার বছর ধরে বিশ্বজুড়ে এমন এক dominating and terrible সমাজ কায়েম করে নিয়েছে যেখানে নারীকে করে রাখা হয়েছে সেকেন্ড সেক্স বা দ্বিতীয় লিঙ্গ। নারী নিজেকে যাতে মনুষ্য পদবাচ্যে বিবেচিত হতে না পারে যুগে যুগে নানা শাস্ত্র, নীতিগ্রন্থ, অ্যাক্ট ও পরিপত্র বানিয়ে নিয়েছে একশ্রেণীর পুরুষেরাই। যে পরিপত্রের অধীনে থাকা নারীদেরকে মগজহীন করে রেখে নারীকেই নারীর হন্তারক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যতদিন ওই পুরুষের বানানো নীতিশাস্ত্র, আইন, রাজনীতি দিয়ে বিশ্ব শাসিত হবে ততদিন পুরুষের করালগ্রাস থেকে নারীর মুক্তি নেই।
বিশ্বাস করা যায়? একটা কোমল শরীর। বেশ কয়েকজন শ্বাপদ পুরুষ। শরীরে ১১৩ টা কামড়ের দাগ। নারীর জননাঙ্গ ও পায়ুপথে নরক নামিয়ে দেয়া যূথবদ্ধ ravishing -এও সাধ মেটেনি। গলার হার ভেঙে খুন করে তারা। কল্পনা করুন জোরজবরদস্তির ভয়াল চাপে মেয়েটির চোখের মনি ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। তবু থামেনি কাপুরুষের ঘৃণ্য লালসা।
হত্যাকারীদের প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার দাবি উঠেছে। এই দাবি নিয়ে উত্তাল প্রতিবাদে কণ্ঠ মিলিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অঙ্গনের তারকারাও।
অপর্ণা সেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কেন পুলিশ রক্তাক্ত মরদেহ দেখেও এটাকে আত্মহত্যার ঘটনা বলে ঘোষণা করলো? কেন পুলিশ তড়িঘড়ি করে এত ব্যস্ত হয়ে উঠলো ময়নাতদন্ত করার জন্য? যে হাসপাতালে এমন ঘটনা ঘটেছে, কেন সেখানেই ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করতে বলা হল?’
কলকাতার অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে পথে নামুন। প্রতিবাদের ভাষা তৈরি হচ্ছে। পিতৃতন্ত্রের শৃঙ্খল দুমড়েমুচড়ে ভেঙে বেরিয়ে আসবে সব নিপীড়িত লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ! এগিয়ে আসুন, অংশ নিন। জোরদার করে তুলি এই লড়াইকে আমরা।’
কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেন, ‘আর জি করের এই ঘটনাকে নিন্দনীয় বললে কম বলা হয়। এ এক অভাবনীয় অপরাধ। হিংসার এ ধরনের বহিঃপ্রকাশ আমাদের শিকড় থেকে ভয় পাইয়ে দেয়, মানবতার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।’
ধর্ষণ-হত্যার ওই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, বিরোধী দলগুলো ‘বাংলাদেশের মতো বিক্ষোভ’ চালিয়ে তার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু এটা এখানে সম্ভব না, কারণ তিনি ক্ষমতা হারানোর ভয় করেন না। তিনি এই গণজাগরণকে বিরোধী দলের তৎপরতা বলেও মন্তব্য করেছেন।
হিন্দুস্তান টাইমস জানাচ্ছে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের মা-বোনদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে জনমনে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আমিও সেই ক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছি। দেশকে, সমাজকে এবং আমাদের রাজ্য সরকারগুলোকে এসব ঘটনা প্রতি আরও গুরুত্ব দিতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে তদন্ত শেষ করতে হবে। যারা এসব পৈশাচিক কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে শিগগির সবচেয়ে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সমাজে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এটা প্রয়োজন’।
আমাদের আত্মস্বার্থ নিমগ্ন রাজনীতি মানুষকে মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব, দায়বোধ শেখায় না। মানুষকে অধিকার সচেতন করে না। যার ফলে দিনের পর দিন ঢাকা কিংবা কলকাতায়, বাংলাদেশ কিংবা ভারতে কোথাও নারীর প্রতি সহিংসতার যথোপযুক্ত বিচার হয় না। নানা রাজনীতির ঘেরাটোপে ফেলে সবকিছু ধামাচাপা দেয়া হয়। হয়তো পুরুষ বিচারকেরা তাদের গোত্রীয় বদনামকে ঘাটাতে চায় না।
কার্যত প্রতিবাদ, রাজনৈতিক আশ্বাস ও কড়া আইন প্রয়োগের হুঁশিয়ারিতেও কলকাতার সামাজিক উত্তাপ থামছে না। পুরো কলকাতাবাসীই এখন বলছে, মানুষ হিসেবে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ন্যায়বিচারের দাবি নিয়ে মৌমিতার জন্য সবাই কাঁদছে। মানুষের অধিকার আদায়ে মানুষেরাই জেগে উঠছে। যেই জাগরণে বারুদ হয়ে জ্বলছে তরুণপ্রাণ মৌমিতার জন্য শোক।
লেখক: সাংবাদিক