মাসকাওয়াথ আহসান:
রক্তাক্ত জুলাইয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্বরতম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। লাশের সংখ্যা নিয়ে নরভোজি টানাহেঁচড়া করা কিংবা হাসপাতালে মৃতদেহ নিবন্ধন খাতা সরিয়ে ফেলার পরেও নিহতের সংখ্যা দু’শোর ওপরে, আহত হয়েছে হাজারের ওপর, এদের অনেকের অবস্থা অনিশ্চিত, আর কারাগারে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী।
শেখ হাসিনা সরকারের হাতে এই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হবার পর থেকে সরকারি মুখপাত্রের ডিনাইয়াল বা অস্বীকার প্রবণতা দৃশ্যমান। এই সরকারটি গত ১৫ বছরে সহস্র ক্রসফায়ার, গুম ও কারানির্যাতনের অপরাধ ঠিক যেভাবে অস্বীকার করে এসেছে।
১৪ জুলাই ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা “চাকরিতে কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতি পাবে না তো কি রাজাকারের নাতি-পুতি পাবে” বলে কটাক্ষ করে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে হত্যার এই ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করেন। ছাত্রছাত্রীরা হাসিনার মন্তব্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে “তুমি কে আমি কে রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার” শ্লোগান দিলে হাসিনা আবার বলেন, নিজেদের রাজাকার বলতে লজ্জাও করেনা!”। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যুদ্ধ ঘোষণা করেন, “নিজেকে যারা রাজাকার বলেছে, তাদের সমুচিত জবাব দেয়া হবে।” আওয়ামী লীগের মন্ত্রী দীপুমণি, আরাফাত, নওফেল, পলকসহ দলটির সমর্থক বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবাল ছাত্রছাত্রীদের শ্লোগানের “কে বলেছে স্বৈরাচার” অংশটি না শোনার ভান করে তাদের ঢালাওভাবে “রাজাকার” বলে ট্যাগিং করতে শুরু করেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সরকার সমর্থক বিশিষ্ট নাগরিকেরা ছাত্রছাত্রীদের “রাজাকার” শব্দটি শ্লোগানে ব্যবহারকে ব্লাসফেমাস বলে ফতোয়া দেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ছাত্র-ছাত্রীদের শ্লোগানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেন।
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে দেশডাকাতি, গণতন্ত্র হত্যা, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশ-প্রশাসন-বিচার বিভাগ দলীয় করণ, বাক-স্বাধীনতার টুঁটি চেপে ধরে “ভয়ের চিরস্থায়ী শাসন” জারি রাখার বিরুদ্ধে যে-ই অভিমত প্রকাশ করেছে; তাকে “রাজাকার” তকমা দিয়ে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। আর সরকার সৃষ্ট যে কোন নৈরাজ্যের জন্য দায়ী করা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতকে। এই রাজাকার-বিএনপি-জামায়াত শব্দ অপব্যবহার করে জনমানুষকে দমিয়ে রাখার বহু ব্যবহারে জীর্ণ ময়লা বস্ত্রখণ্ডটি রিফু করার সক্ষমতা হারিয়েছে। গান্ধা কইরা দেয়া ও চরিত্রহননের অপরাজনীতির আবেদন ফুরিয়েছে।
ট্যাগিং বা তকমার রাজনীতি কাজ করছে না দেখে হিংস্র হয়ে ওঠে তিনটি বে-আইনি নির্বাচনের মাধ্যমে চেপে বসে থাকা দখলদার গোষ্ঠীটি। ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হারানোর ভয়ে রক্তপিপাসু হয়ে যায় হাসিনা প্রশাসন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-পুলিশ-বিজিবি-আনসার লেলিয়ে দিয়ে নির্মম এথনিক ক্লিনসিং শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ংকরতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করে ফেলে তারা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী এই অপরাধকে ডিনাই বা অস্বীকার করে জুলাই গণহত্যা-জননির্যাতন ও ঢালাও গ্রেফতারের অপরাধগুলোকে দীর্ঘায়িত করেন। আওয়ামী লীগের জোট সহযোগী হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে সংকটের ছাত্রছাত্রী হত্যার ফ্রন্টটিকে ঢেকে দিয়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের বহু ব্যবহারে জীর্ণ পাণ্ডুলিপি আয়োজনের পরামর্শ রাখেন। জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকেই ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসক নরেন্দ্র মোদী নিয়ন্ত্রিত গদি মিডিয়ায় তার থিংক ট্যাংক বীণা সিক্রি, হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এই “জামায়াত জামায়াত” “মৌলবাদ মৌলবাদ” ব্রজবুলির নেসেসারি ইলিউশান তৈরি করতে থাকেন।
কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে জুলাই গণহত্যা খুব সম্ভব প্রথম অনক্যামেরা ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটি। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই হতাকান্ডগুলোর ভিডিও ভেরিফাই করে নিশ্চিত হয়ে হাসিনাকে জাতিসঙ্ঘের অধীনে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহবান রেখেছে। গোটা পৃথিবীর মিডিয়ায় জুলাই কিলিং শিরোনাম হয়েছে; অসংখ্য সম্পাদকীয়তে শেখ হাসিনাকে “স্বৈরাচারী শাসক” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি নিয়ন্ত্রিত টিভি ও ওয়েব পোর্টালগুলোর “জুলাই-এর মানবতাবিরোধী অপরাধ” ধামাচাপা দেবার অপচেষ্টার মাঝেও বাংলাদেশের সত্যান্বেষী সাংবাদিকেরা জুলাই হত্যাকাণ্ডের খবরগুলো প্রকাশ করেছেন।
১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ভয়ের শাসনে স্তব্ধ হয়ে থাকা জনমানুষ; তাদের সন্তান হত্যায় আর চুপ করে থাকতে পারেনি। রিক্সাচালক, ক্ষুদে দোকানি, মেহনতি মানুষ, আইনজীবী, শিক্ষক, শিল্পী; জীবনের প্রতিটি হাঁটা পথের মানুষ তাদের সন্তান হত্যার বিচার চাইতে পথে নেমেছে। সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্য সংস্কার আন্দোলনটি জুলাইয়ের রক্তে ভিজে এখন ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’ আন্দোলনে রুপান্তরিত হয়েছে।
রক্তাক্ত জুলাই রেনেসাঁ শোক ও শক্তির মিশেলে এক অদম্য গণ অভ্যুত্থান। বাংলাদেশের পুনর্জন্মের আহবান এখন প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে। সত্যদ্রোহ যখন প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের মস্তিষ্কে, তখন কবরস্থান ও কারাগারে আর জায়গা নেই সে দ্রোহকে সমাহিত কিংবা আটক করার।