প্রসঙ্গ: স্কুলছাত্রী মুক্তি রাণী বর্মণ হত্যাকাণ্ড

আসলাম আহমাদ খান:

‘অপরাধীর কোন দল নেই’— এটি একটি সুন্দর শ্লোগান। শ্লোগানের ভাষা সুন্দর কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবে দল ও প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়াতেই অপরাধীরা পায়ের নিচে শক্ত মাটি পায়। বলছিলাম নেত্রকোণার বারহাট্টায় বখাটের দায়ের কোপে ১৪ বছর বয়সী স্কুল ছাত্রী মুক্তি রাণী বর্মণের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে। গত ২ মে স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার পথে কাওসার নামের এক উত্যক্তকারী বখাটে যুবকের দায়ের কোপে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই চিরতরে ঝরে গেল প্রেমনগর ছালিরপরা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মুক্তি রাণী বর্মণের জীবনকলি।

মুক্তি রাণী বর্মণ

নিহত মুক্তি অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল একটি পরিবারের সন্তান, কিন্তু দরিদ্র ছিল না। তারা ছয় বোন। সে পরিবারের চতুর্থ সন্তান। পূর্বের মেয়েগুলো এই স্কুলে ফার্স্ট গার্ল, সেকেন্ড গার্ল ছিলো। সে নিজেও ফার্স্ট গার্ল ছিলো। এ বছর হয়েছিলো চতুর্থ। পিছিয়ে পড়ার কারণ জীবিকার জন্য পড়াশুনার পাশাপাশি তাকে টেইলারিং এর কাজ করতে হতো। সবকিছু সামলিয়ে সে নাটক, খেলাধূলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতো। স্বপ্ন ছিলো বড় হয়ে বিসিএস অফিসার হবে। স্বপ্নের পাখিটি ডানা মেলার আগেই অকালে ঝরে গেলো। এর দায় কে নেবে ? দায় কি শুধু দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া ঐ বখাটের? এই সমাজে আমরা যারা বসবাস করি আমাদের কি কোন দায় নেই ?

আজ সকালে মেয়েটির এক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ওর ছোট বোনটিকেও সে উত্যক্ত করতো। বখাটের বাবার কাছে অভিযোগ দেওয়াতে সে আরও ক্ষুব্ধ হয়। ভয়ে তার মা-বাবা ছোট বোনটিকে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে অনার্স ক্লাসে অধ্যয়নরত বড় বোনের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। ছোট বোনের অনুপস্থিতিতে বড় বোনকে উত্যক্ত করতো, যার করুণ পরিসমাপ্তি ঘটলো খুনের মাধ্যমে।

এই যে এতোগুলো ঘটনা ঘটলো অথচ ঐ সমাজের কেউ জানলো না ? নাকি আমরা চোখ বন্ধ করে পালিয়ে বেড়াই, শুধু নিজেকে রক্ষা করতে চাই। এভাবে কি শেষ রক্ষা হবে? রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতির নামে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ফ্রাংকেনস্টাইন দানব আমরা তৈরি করছি, আমরা না চাইলেও সমাজে এমন ঘটনা আরও ঘটবে।

শান্ত ও নিরিবিলি পল্লীনগর বারহাট্টা ক্রমান্বয়েই অশান্ত হয়ে উঠছে। কয়েক বছর আগে তুচ্ছ কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্জুন বিশ্বাসকে জনসমক্ষে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আসামী ধরাও পড়েছে। কিন্তু এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বড় কোন সামাজিক প্রতিরোধ দেখিনি। মূলতঃ তোষামোদ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থে পরিপূর্ণ অসুস্থ এক সমাজে বসবাস করছি আমরা।

সমাজে দিনে দিনে উগ্রতা বাড়ছে। কেউ কাউকে মান্য করে না। যার লাঠি কিংবা প্রতিপত্তি আছে তাকে আমরা সমাজপতি বানাই। আর সমাজপতিরা সমাজ বিনির্মাণের পরিবর্তে দল ভারী করে। সে দলে চোর, বাটপার, ধর্ষক, ইভটিজার থাকলে অসুবিধা নেই। সমাজের সুন্দর চিন্তার মানুষগুলো কোণঠাসা, জড়সড়। কেউ কাউকে উপদেশ দেওয়ার সাহস পায় না।

কেউ কেউ বলছেন এটি একটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড। যারা বলছেন এটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড, তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়— এই মেয়েটি যদি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র কোন বড় নেতা-নেত্রীর অথবা ইউএনও কিংবা থানার ওসির সন্তান হতো, তাহলে কী এই ঘটনা ঘটতো ?

আসামী দ্রুত ধরা পড়েছে এতে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি। কেউ কেউ পুলিশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অপরাধী দ্রুত গ্রেফতার হওয়াতে পুলিশ প্রশংসা পেতেই পারে, কিন্তু এ প্রশংসা যেন সীমা লংঘন করে চাটুকারিতায় রূপ না নেয়। ভুলে গেলে চলবে না আসামীকে ধরা পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব। সমাজে এমন ঘটনা প্রতিরোধ করাও পুলিশের দায়িত্বের মধ্যেই ছিলো। বিগত দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা বলে, কিছুদিন যেতে না যেতেই দরবার কিংবা মীমাংসার নামে ঐ বখাটে যুবককে বাঁচানোর জন্য সমাজের এক শ্রেণির প্রভাবশালী মানুষ উঠেপড়ে লাগবে। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য পরিবারকে ভয় দেখাবে। ভয়ে কেউ সাক্ষী দিতে যাবে না। সংখ্যালঘু এই পরিবারটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ সকল বিচার প্রক্রিয়ার পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আশাকরি পুলিশ সে ভূমিকা পালন করবে।

স্কুল কর্তৃপক্ষেরও সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। তারা এ বিষয়টি পূর্ব থেকে না জানলেও, প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী স্কুল থেকে নিরাপদে বাড়িতে না ফেরা পর্যন্ত তারা তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। তাছাড়া স্কুলেও এমন অভিযোগ বলার মতোন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাহলে মুক্তি ও তার পরিবার আগেই জানাতে পারতো স্কুল কর্তৃপক্ষকে। এমন করুণ পরিণতি হয়তো এড়ানোও সম্ভব হতো প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হলে।

আমি জানি সন্তানসম শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে শিক্ষকবৃন্দ অনেক বেশি শোকাহত এবং মর্মাহত। কিন্তু শোককে একপাশে ঠেলে ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় ঘটনা না ঘটে — এ বিষয়ে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁদেরকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করে অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।

আর আমাদের সমাজপতিদের অপরাধীদের দিয়ে দল ভারী করার পরিবর্তে সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা কোন ধর্ষক বা খুনীকে রাজনৈতিক দলের মিছিলে দেখতে চাই না। কোন সমাজ বিরোধীকে প্রশাসনের মিটিংয়ে দেখতে চাই না। প্রত্যেক গ্রামে, পাড়ায়-মহল্লায় মাদকাসক্তি, নারী নির্যাতন ও ইভটিজার প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। সে কমিটিতে অপরাধী এবং সমাজ বিরোধী কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তিরা ছাড়া নারী-পুরুষ, দলমত নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশিং মডেলকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে প্রশাসনিক সহায়তা পাওয়া যাবে।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, “ Be an Upstander, Not a Bystander”। আমাদের সকলকে Upstander হতে হবে। অর্থাৎ কোন ঘটনা ঘটলে সকলে সোচ্চার হয়ে মন্দ ঘটনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে হবে। নিজের গা বাঁচিয়ে চলা কিংবা একা ভাল থাকার চিন্তা পরিহার করে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ একা ভাল থাকা সম্ভব নয়। সমাজটা সকলের, সকলে মিলেই ভালো থাকতে হবে।

আসলাম আহমাদ খান
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী লেখক ও সমাজবিজ্ঞানী।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.