লেখালেখি: নারীর জন্যে চ্যালেঞ্জিং

রিমি রুম্মান:

কলম্বীয় সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস লেখালেখির কাজ করতেন সকাল নয়টা থেকে। ভোরে উঠে প্রাতঃভ্রমণের পর বিশ্রাম নিয়ে কড়া এককাপ কফির সঙ্গে টোস্ট খেয়ে লেখার ঘরে ঢুকতেন। তাঁর স্ত্রী ইতিমধ্যে পড়ার ঘর গুছিয়ে পরিচ্ছন্ন করে রাখতেন। ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে টেবিলে রাখতেন। রুলটানা কাগজ, সিগারেট, লাইটার, ফাউন্টেন পেন রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার আগে স্বামীর কপালে চুম্বন দিতেন। যাতে মিশে থাকতো প্রার্থনা আর ভালোবাসা। একজন লেখক স্বামীর জন্যে স্ত্রী মের্সেদেস উৎসাহব্যঞ্জক ও উদ্দীপক শক্তি হিসেবে কাজ করতো। লেখকের সাফল্যের পেছনের মানুষটি ছিলেন স্ত্রী মের্সেদেস।

একবার মার্কেজের জর হলো। লেখার ছন্দ নষ্ট হয়ে গেলো। লেখকের চেয়ে তাঁর স্ত্রীই বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনায় বসলেন। স্বামীর গায়ের ওপর কম্বল মুড়ে দিলেন। এমন পরিবেশ তৈরি করলেন যে, মার্কেজ জেগে উঠলেন।তার শরীরের জর ও ক্লান্তি উবে গেল। তিনি পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন ও লেখার টেবিলে গিয়ে বসলেন।

‘লাভ ইন টাইমস অব কলেরা’ (কলেরার সময়ে প্রেম) উপন্যাসের বিষয়ে মার্কেস একবার মজা করে গুরুত্বের সাথে বলেছিলেন, এটি তাঁর স্ত্রীর যাদুকরী ক্রিয়াকলাপের ফসল। কেননা এটি লেখার শুরুতে তিনি কমপক্ষে সাতবার কাটাকুটি করেছিলেন। এবং দুই মাসের অধিক সময় লেগেছে শুধুমাত্র প্রথম পরিচ্ছেদ লিখতে। সেই সময় স্ত্রী মের্সেদেস উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ফাদারদের মন্ত্রপূত একটি প্রায় শত বছরের পুরনো সিল্কের শাল বের করে তাঁর স্বামীর বসার চেয়ারে বিছিয়ে দেন। ব্যস, অমনি সকল সংকটের সমাধান হয়ে যায়।

মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্যারিসে বাড়ির কাছেই একটি ক্যাফেতে যেতেন। স্থানটি ঘরোয়া পরিবেশের, আরামদায়ক ও উষ্ণ। সে তাঁর হ্যাটটা বেঞ্চের উপর র‍্যাকের সাথে ঝুলিয়ে এক মগ ক্যাফে-ও-লে অর্ডার দিতেন। বেয়ারা ওটা নিয়ে এলে কোটের পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বের করে লিখতে শুরু করতেন। লিখতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হারিয়ে যেতেন লেখার গভীরে। প্যারিসের আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলে প্যারিস ছেড়ে সস্ত্রীক অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবতেন। তাঁর ভাষায়, যেখানে বৃষ্টির বদলে পাইনবন জুড়ে তুষারপাত হবে, রাস্তাঘাট, পাহাড়ের গোড়া বরফে ঢেকে যাবে এবং এমন উচ্চতায় যে রাতের বেলায় হেঁটে ঘরে ফেরার সময় শোনা যাবে বরফ ভাঙার মুড়মুড়ে আওয়াজ।

উপরের উদাহরণ দুটি কেন টানলাম?
প্রায়শই শোনা যায় ‘লেখক তো লেখকই, তাকে নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে আলাদা করা ঠিক নয়’। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কী বলে? প্রকৃত বাস্তবতা হলো, সমাজ সংসারে নারীদের একটি সীমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বেশ কয় বছর আগে জাপানি কথা সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির এক সাক্ষাৎকার পরেছিলাম। সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের সবচে প্রয়োজনীয় কোন গুণটি থাকতে হয়? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘মেধা, মনঃসংযোগ আর সহিষ্ণুতা’। প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসে নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর একজন নারীর মনঃসংযোগ দেয়ার সময় কোথায়? একজন পুরুষ লেখককে পরিবারের সদস্যরা রোজ পড়ার টেবিলে বসে কিছু শেখা বা অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়। এতে আপনা থেকেই মনঃসংযোগ হয়। ফলে তারা নিশ্চিন্তে, নির্বিঘ্নে লেখার জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো আত্মস্থ করতে পারে।

মুরাকামি বিষয়টিকে তুলনা করেন এইভাবে, ‘প্রতিদিন দৌড়ালে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন দৌড়বিদের দৈহিক গঠন উন্নত হয়, পেশী শক্তিশালী হয়। লেখালেখির বিষয়টিও ঠিক তেমন। একে ধরে রাখতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন। একের পর এক সঠিক শব্দ বাছাই করে শূন্য থেকে তুলে এনে কাহিনী নির্মাণ করা কিংবা গল্পের প্রবাহকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মনঃসংযোগ ও সহিষ্ণুতার বিকল্প নেই।’ কিন্তু সকল ধরণের বাঁধা অতিক্রম করে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া একজন পুরুষের জন্যে যতখানি সহজ, নারীর জন্যে মোটেও তা নয়। নারীদের বলা হয় ‘গৃহশোভা’। গৃহকর্মে নৈপূণ্য দেখানোই যেন তাদের কাজ।

লেখালেখি আমার কাছে অনেকটা ধ্যানের মতো। প্রার্থনার মতো। একজন নারী লেখক যখন অনেক কিছু লিখতে চান, তার মস্তিষ্কে অগণন বিষয়, লেখার উপকরণ ঘুরে বেড়ায়, অথচ সময়, সুযোগের অভাবে লিখতে পারেন না, তখন তার ভেতরে গভীর এক যাতনা কাজ করে। লিখতে না পারার বেদনায় ছটফট করেন। লেখালেখি তখন তার জন্যে চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। সমাজ সংসারে একজন মানুষ যখন অন্য কারো প্রভাবাধীন থাকে, তখন সে তার ভাবনার স্বাধীনতা হারায়। কিন্তু একজন লেখকের লেখালিখি করার যে গুণ, অগ্রজদের মতে তা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। তাকে দাবিয়ে রাখা যায় না। কোনো না কোনোভাবে একদিন সে লেখালেখিতে আত্নপ্রকাশ করবেই। আমি যখন স্কুল জীবনে লিখতাম, তখন তা প্রকাশে কুণ্ঠিত থাকতাম। এমনভাবে লুকিয়ে রাখতাম, যেন কারো নজরে না পড়ে। বিষয়টি অনেকটা একজন অপরাধীর অপরাধ লুকানোর কৌশলের মতো।

আমার সময়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যকিছু পড়া বা লেখা একরকম অপরাধের পর্যায়েই ধরা হতো অনেক পরিবারে। আমি আসলে পরিবারের অন্য সদস্যদের হাস্যরসের কারণ হতে চাইনি। তাই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোথাও লেখা প্রকাশের কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। কিন্তু তাই বলে থেমেও তো থাকিনি! সেই শৈশবে প্রথম ছড়া লিখেছিলাম আমার আব্বাকে নিয়ে, আমাদের মধ্যবিত্ত টানাপোড়েনের জীবন নিয়ে। এই তো গত সপ্তাহে সাহিত্য একাডেমী, নিউইয়র্ক এর যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে সঞ্চালক যখন লেখালেখির শুরুর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, উত্তর দিতে গিয়ে, ছড়াটি পাঠ করতে গিয়ে খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলাম। কেননা আমার আব্বা কোনোদিনই জানতে পারেননি তাঁর প্রতি আমার এক পৃথিবীসমান ভালোবেসে লেখা সেই ছড়াটির কথা।

প্রবাস জীবনের রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা সময়েও যখনই ফুসরত পেয়েছি, লিখে গিয়েছি পাতার পর পাতা। অন্য অনেক নারীর মতো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার মেইকআপ, লিপস্টিক, কিংবা আইলাইনারে পূর্ণ ছিল না। ওসব ব্যবহারে অদক্ষতা কিংবা অনাগ্রহতা ছিল হয়ত। বিধায় সেখানে ঠাই পেত বিরামহীন লিখে চলা কাগজ-কলম। সেখানে স্থান করে নিয়েছিল শাদা কাগজে কালো হরফে একলা পরবাস জীবনে যুদ্ধরত এক তরুণীর কোমল অনুভুতির গল্প। স্বজনহীনতার হাহাকার। অচেনা দেশে অচেনা কিছু মানুষের সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসার গল্প। তাদের সুখদুঃখ, ব্যাথা-বেদনার কাব্য। ড্রয়ার ভর্তি সেইসব গল্প একদিন স্থান-সংকুলানের অভাবে স্তূপীকৃত করে ফেলে আসা হতো ময়লার ঝুড়িতে। এইসব প্রকাশের যোগ্য কিনা, কিংবা কোথায়, কাকে দিলে প্রকাশিত হবে, এমন ভাবনা মনে আসেনি। শুধু জানতাম, আমাকে লিখতে হবে। কেনো? লিখে শান্তি পেতাম। স্বস্তি পেতাম, তাই। যখন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকলো, আমার চারপাশের চেনা মানুষজন অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইত, কবে থেকে লিখি। এমন কী স্কুল জীবনের সহপাঠীরাও চোখ গোলাকৃতি করে জানতে চাইত, কবে থেকে লিখছিস রে? কখনো তো তোকে লিখতে দেখিনি বা শুনিনি! আমার প্রায়শই মনে হতো, আমি হয়ত জাত লেখক নই, কিন্তু আজন্ম বিরামহীন লিখে গিয়েছি।

আমার এক লেখক বন্ধু ইয়াসির (ছদ্মনাম) গল্পচ্ছলে বেশ আনন্দিত স্বরে বলেছিল, নির্বিঘ্নে লেখার সুযোগ করে দিতে তার স্ত্রী সুনিপুণ হাতে সন্তানদের সামলে রাখে। পানি লাগবে কিনা, চা, কফি লাগবে কিনা সেইদিকটা খেয়াল রাখে। তাকে ভাবনার সুযোগ করে দিতে পৃথিবীর অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ থেকে আগলে রাখে। নিরিবিলি থাকতে সহযোগিতা করে। আমার মনে পড়ে গেল কোথায় যেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রাক্তন স্ত্রী গুলতেকিনের এক সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম, হুমায়ুন আহমেদ যখন রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে জোছনার থৈথৈ আলো উপভোগ করতেন, কিংবা লিখে সেই অনুভূতি ব্যক্ত করতেন, তখন গুলতেকিন সন্তানদের রাতের খাওয়া, ঘুম পাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু একজন নারী লেখক সংসারের সব কাজ সামলে, পরিবারের সকলে ঘুমালে যখন লিখতে বসেন, তখন রাজ্যের ক্লান্তি ঘিরে ধরে তাকে। আমার অন্য এক লেখক বন্ধু রুমালি (ছদ্মনাম) জানিয়েছে, অদম্য তৃষ্ণা থেকে সে যখন ঘরের কোণের ছোট্ট বাতিটি জ্বালিয়ে লেখায় মনোনিবেশ করে, তখন স্বামী কিংবা শাশুড়ি ঘুমোতে যাবার তাগিদ দেয়। ভোরে উঠতে হবে, সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতে হবে, এমন হাজারো কারণ মনে করিয়ে দেয়। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে, এমন ভালোবাসা দেখাতেও ভুলেন না। এ পর্যন্ত তবুও মেনে নেয়া যায়।

কিন্তু আরেকজন লেখক (নারী) বন্ধুর অবস্থা আরও নির্মম। স্বামী-স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে ছোট্ট সুখি পরিবার তার। বাচ্চাদের রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে সে যখন লিখতে বসে, স্বামীর উপর্যুপরি তির্যক মন্তব্য লেখালেখির প্রতি মনঃসংযোগ ব্যহত করে। ‘ লিখে কী হবে, এইসব ছাইপাঁশ লিখে কত টাকা পাও, খামোখাই নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানো আর কী!’ কারো আবার পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা নেই, কিন্তু সব কাজ শেষে মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায়, সকালে পরিবারের সকলকে নাস্তায় কী দিবে, দুপুরে কী রান্না হবে, সন্তানদের ডাক্তার এপয়েনমেন্ট, স্কুলে প্যারেন্ট টিচার কনফারেন্স, লাইব্রেরীর বই জমা দেয়ার তারিখ… ইত্যাদি। এতসব চিন্তাযুক্ত মস্তিস্কে একজন নারী লেখকের জন্যে লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া সত্যিই চ্যালেঞ্জিং।

বইমেলা একজন লেখকের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। আবেগের স্থান। দেশে যখন বইমেলার বাতাস বয়, প্রবাসের অধিকাংশ পুরুষ লেখক স্ত্রীর কাঁধে সংসারের দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে, উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে যায় দেশে। প্রতিদিন পাঞ্জাবী পরে কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে পাঠকদের অটোগ্রাফ দেয়। টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেয়। নিজের বই সম্পর্কে প্রচারণা করার সুযোগটুকু কাজে লাগায়। এতে পাঠকের সঙ্গে লেখকের একরকম যোগসূত্র তৈরি হয়। লেখালেখির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আত্নিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

দূরদেশ থেকে এইসব দেখে একরকম ভালোলাগার অনুভূতি হয়। পক্ষান্তরে যতই দেশের বইমেলার দিকে মন পড়ে থাকুক না কেনো, একজন নারী লেখক চাইলেই সংসার, সন্তান রেখে দেশে ছুটে যেতে পারেন না। কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা তার আবেগকে, চাওয়াকে সন্মান জানিয়ে বলেন না যে, কয়টা দিন আমরা সব সামলে নেবো, তুমি ঘুরে আসো। এতে করে সে সুদূরের অচেনা মানুষটিই রয়ে যায়।

সুতরাং বলা চলে একজন নারী লেখকের লেখালেখির পথ কোনক্রমেই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তবুও তারা সকল সামাজিক, পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাওয়া শরতের শাদা কাশফুলের মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। যদিও সময় বদলাচ্ছে। এখন নারী লেখকরা আর আগের মতো তেমন বিধিনিষেধ মানতে রাজি নন। এখন তারা নারী লেখকও নন। এখন কেবল লেখক। ফলে দরোজা-জানালা খুলতে শুরু করেছে।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.