নারী দিবস আর আমার ভাবনা

ফাহমিদা খানম:

ঘটা করে একদিন নারী দিবসের পক্ষে না থাকলেও এখন মনে হয় একদিন না হয় নারী নিজের জন্যে চিন্তা করুক।
দায়িত্ব কর্তব্য ছেড়ে নির্মল আনন্দে ডুবে থাকুক। একদিন না হয় প্রজাপতির ডানায় ভর করে নিজের কথা ভাবতে শিখুক !
হাজার বছরের সংস্কার আজও আমাদের অস্থি-মজ্জাতে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে বেঁধে আছে নাকি আমরাই নিজেদের পরিবর্তন করতে পারিনি, কে জানে?

এক সময়ে ভাবতাম শিক্ষার হার বাড়লে নিশ্চয় চারপাশের অবস্থাটা বদলে যাবে, তারপর সময়ে বুঝেছি ভেতর থেকে পরিবর্তন না এলে কোনো সনদই আসলে মানুষকে বদলাতে পারে না।

একটা পরিবারে যখন সন্তান জন্ম নেয় সে ছেলে নাকি মেয়ে এই বোধের চাইতেও বেশি জরুরি সুস্থ সন্তানের মা বাবা হওয়া, আর তাদেরকে সঠিক সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলা। পরিবারে জন্ম নেওয়া মেয়েটা শৈশব থেকেই বুঝে যায় জীবনের পথটা আসলে মধুর না। অযাচিতভাবে কতো নোংরা হাত থেকে নিজেকে যে বাঁচিয়ে চলতে হয়! কাছের মানুষ দিয়ে নির্যাতিতা হলেও অধিকাংশ পরিবার চুপ থাকতে বলে সামাজিকতার দোহাই দিয়ে, আর এই চুপ থাকার চক্কর জীবনভর কেবলই চলতে থাকে। ছোটখাটো কাজে উৎসাহ দেওয়া পরিবারের মেয়েটি কাগজে স্বাক্ষর করে নতুন জীবনে পা দিয়ে অনুভব করে এতোদিনের শিক্ষা কিছুই না তার জীবনে।

বেশিরভাগ পরিবারে নিজেদের মেয়েরা কিছু না পারলেও আক্ষেপ করে না, কিন্তু পুত্রবধুর বেলায় আকাশকুসুম কল্পনার ভার নতুন মেয়েটির উপর অবধারিতভাবেই চলে আসে। বৈষম্য, অন্যায় করার পরেও নিজেদের করা কাজের উপর অটল থাকা মানুষেরা নিজেদের কন্যার জায়গায় কখনও বউদের বসানোর সাহস করে না। অন্যায় কেবল শ্বশুরবাড়িই করে না, অধিকাংশ মেয়ের মা বাবা বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব সারে বলেই পরিবর্তন আসে না সংসারে। বাবারা মেয়েদের সম্পত্তি থেকে ঠকায়, ভাইয়েরাও ঠকায়, এভাবেই শুরু হয়, তারপর বাকি জীবনে দায়িত্ব আর কর্তব্যের চাপে মেয়েটি একসময় আবিষ্কার করে কেউই সেসব মনে রাখার দরকারটুকু মনে করে না।

অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হলেও অনেক নারীই এখন পর্যন্ত নিজের আয়টুকুও রাখতে কিংবা নিজের পছন্দমতো খরচ করার অধিকার রাখে না আর এটাই এই দেশের আসল চিত্র!

অনেকেই হাসতে হাসতে বলেন – আমাদের নানী, মায়েরা কতো সংগ্রাম করেছে! ধান সেদ্ধ করেছে , যৌথ পরিবারে ৭/৮ সন্তানের মা হয়েও নিজের সন্তানদের জন্যে আলাদা কিছু করতে পারেনি, তাই বলে কি মানুষ হইনি? এই যুগের নারীদের এতো আরাম আয়েশের পরেও অভিযোগের সীমা পরিসীমা নাই!

এসব মানুষেরা এখনও আশা করে আছেন নারীরা দশভুজা হয়ে সব সামলাবেন, আর উনারা অফিস করে গায়ে হাওয়া খেয়ে বেড়াবেন। কী উদ্ভট চিন্তাভাবনা! শিক্ষিত এসব মানুষের পাশে সনদ থাকলেও ভেতরবাড়ি সেই আদ্যিকালেরই রয়ে গেছে। মনের দৈন্যতা ভয়ংকর ব্যাপার।

ভোরে রাস্তায় বের হলেই চোখে পড়ে সন্তানদের নিয়ে মায়েদের স্কুল/কলেজ/কোচিং নিয়ে যাবার দৃশ্য, বাবাদের ব্যস্ততার জন্যেই মায়েদের এই যুদ্ধ করতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান বাসা থেকে দূরে বলে বাচ্চা নিয়ে একেবারেই ফিরেন, তারপর বাসায় ফিরে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। আজকাল কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না বলে মায়েদের কতো বাড়তি দায়িত্ব যে পালন করতে হয়! তুলনা করার আগে ভাবতে হবে কাজের পরিধি বেড়েছে আর সন্তানের ব্যাপারে উদাসীন হলে কি চলে? আয়াতের কথা মনে আছে? মায়েরা সন্তানের নিরাপত্তার জন্য কতটা ত্যাগ করেন বোঝার মানসিকতা থাকতে হবে।

পরিচিত এক মুরুব্বি সেদিন কথায় কথায় জানালেন ছেলের জন্যে উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাচ্ছেন না, কারণ আজকালকার মেয়েরা কেউই নাকি ‘পারফেক্ট’ স্ত্রী হতে চায় না, সবাই নিজের ক্যারিয়ার আর নিজেরটা নিয়েই ভাবে।
পারফেক্ট বলতে কী বোঝালেন বুঝিনি বলে জানাতেই বললেন –
‘তোমার চাচীর সাথে আমার সংসার ৫০ বছরের। বিয়ের পর থেকেই আমার সব কাজ ও নিজের হাতে করে। উনি আবার প্রতিবেলায় ফ্রেশ রান্না ছাড়া খেতে পারেন না, আর উনার যাবতীয় সব কাজ করতে হয় বলে স্ত্রীর কখনও কোথাও যাওয়া হয় না”।

আমি পারফেক্টের উত্তর পেয়ে ভাবলাম, পতিসেবা করতে গিয়ে জীবনের সব আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার নাম বুঝি পারফেক্ট? মুরুব্বীর স্ত্রী বাতের ব্যথায় অনেক বছর ধরে ভুগছেন জেনে বললাম—
“আন্টি যে এতো সিক, আপনি তার কি সেবা করেন?”
“এসব মেয়েলী কাজ আমি কেন করবো?”
কর্কশ স্বরে উত্তর পেয়ে খুব একটা অবাক হলাম না, কারণ এসব মানুষ কতোটা স্বার্থপর যে নিজের যত্ন পাওয়াকে স্বাভাবিক মনে করে আর স্ত্রীর বেলায় একেবারেই উল্টো! সন্তানেরা বাবাকে দেখে কী শিখলো অথবা অজান্তে বিষ এভাবেই রয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, আর এই বোধের জন্যে যে ঘিলু দরকার তা অনেকেরই নাই। ছেলেকে শিক্ষিত করলেও লাভ নাই, কারণ সে আসল শিক্ষা পায়নি, এসব পরিবারের উচিত হবে সহকারি টাইপের মেয়ে বিয়ে করানো, কারণ নারীদের মানুষ ভাবতে শিখেনি, কেবলমাত্র সনদধারী বেকুবই হয়েছে।

আরেকজন মা আক্ষেপ করে জানালেন, পুত্র প্রবাসী, কিন্তু বউয়ের তাদের সেবার দিকে মন নাই।
জানলাম, ভোরে উঠে সবার নাস্তা বানিয়ে কন্যাদের নিয়ে স্কুলে যায়, ফেরার পথে বাজার করে দুপুরের রান্না সেরে আবার তাদেরকে আনতে যায়। বাসায় ফিরে গোসল খাওয়া সেরে বাচ্চাদের নিয়ে কোচিং ক্লাসে যায়, সন্ধ্যার পর ফিরে একটু টিভিতে সিরিয়াল দেখে। সমস্যা কোথায় বুঝতে না পেরে জানতে চাইলে বললেন, উনাদের পছন্দের রান্না করে না, আর মাঝেমধ্যে সন্ধ্যার নাস্তা কিনে আনে। এসব উনাদের পছন্দ না, একজন নারী যখন আরেক নারীর যুদ্ধটা দেখেও অনুভব করতে পারে না, কী বলার থাকে তখন! এতোটা স্বার্থপর হলে সংসার সমাজ কীভাবে বদলাবে?

আমি অনেক মানুষের মুখেই শুনি –
“ঘরের কাজ আবার কাজ নাকি? আমাদের মায়েরা কি করেনি এসব?”
সেই মায়েদের মহত্ত্বের কোনো তুলনা চলে না, কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখুন জীবিত স্ত্রী অথবা মায়েদের কতটা মুল্যায়ন হয়েছিলো? মহত্ত্বের তুলনা করতে গিয়ে নিজের সন্তানের মায়ের সাথে আপনাদের আচরণটা কেমন! মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করেন, অথচ জীবিত অবস্থায় কতটা মূল্যায়ন করেন? মায়ের সাথে তুলনা করার সময় বাবার আদরের রাজকন্যারা বাবার কতোটা আদরের সেটা মনে রাখেন কি? বাবাদের রাজকন্যারা দায়িত্ব আর কর্তব্যের চাপে পড়ে নিজের কথা ভুলে যায়, স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যায়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আবিষ্কার করে তাদের শুধু একটা অতীত আছে, যেখানে সে সবার আদরের ছিলো।

দুজন মানুষের একসাথে দীর্ঘপথ হাঁটতে হলে সঠিক জীবনসংগীর দরকার, আর সেটা না হলে অশান্তির জন্মই হয়, সন্তান অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় হয়ে হীনমন্যতায় ভোগে আর বিয়ে শব্দকে ভয় পেতে শুরু করে, এটাও কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার। কারণ বিয়ে না করে তখন বিপথে যায়।
মানুষ মাত্রই ভুল ত্রুটি হবেই, এখন সবাই মিলে যদি আশা করে নারীদেরই কেবলমাত্র পারফেক্ট হতে হবে আর স্যাক্রিফাইস তাকে একাই করতে হবে তাহলে এসব মানুষদের কী বলার থাকে? নারী রক্তমাংসের মানুষ এটা বুঝতে না পারলে বোঝা যায় এদের মস্তিষ্কে ঘিলু ব্যাপারটা না-ই।

নিজেদের স্বার্থে ভিন্ন পরিবারের একজনের কাছে এতোটা আশা করেন, অথচ নিজেরা কী করেন? বিয়ে হলে নারী একাই সবকিছু সামলাবে কেনো? এসব আচরণের কারণে অনেকেই বিয়েকে ভয় পেতে শুরু করেছে অথচ সহজ হলে এটা হতো না।

নারীরা আছে বলেই চারপাশটা এখনো সুন্দর আছে। কন্যা হয়ে স্ত্রী হয়ে মা হয়ে দায়িত্ব করছে বলেই সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, এতো কাজের পরেও সমালোচনা করেন বলেই তিক্ততা ভর করে আপনাদের আচরণে। নারী রক্তমাংসের মানুষ, তাদের অনুভূতিকে সম্মান দিতে শিখুন, তাতে করে সংসারে শান্তি আসবে, আর সন্তানেরাও সুস্থ পরিবেশে বড় হবে।

চারদিকে তাকালে নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখে মনে হয় ক্যারিয়ারের জন্য ভাবার চাইতে ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানবিক আর সুশিক্ষার।

নারীকে পারফেক্ট হবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের সমব্যথী হলে জীবন সহজ হবে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দায়িত্ব পালন করাকে মূল্যায়ন করতে শিখুন। ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মানবিক সুসন্তান গড়ে তোলার উপরে জোর দিতে হবে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষাটাও জরুরি।

কিছু মানুষের আচরণ দেখে বুঝে যাই সেকাল আর একালের মধ্যে পার্থক্য কেবল লেবাসে আর মননে, তখন মনে মনে বলি, আধুনিক হলেও মনের ভেতরবাড়ি এখনও স্যাঁতস্যাঁতে আর ঘুণেধরা, আর এদের জন্যেই চারপাশটা বদলায় না, সেই দলে পুরুষ একা না, স্বজাতীয়রাও বহাল তবিয়তে আছেন।

৮/৩/২০২৩

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.