ঘর বা ব্যবসা কোনটাই যদি না সামলাই?

ডা. নাজিয়া হক অনি:

প্রতিবার নারী দিবস আসে আর একটা করে নতুন ‘কাইজ্জা লাগানো’ টপিক অফসাইডে চালু হয়। এবার গ্রামীণ ফোন সেই কাজটি করেছে “ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই” স্লোগান দিয়ে এবং রীতিমতো সার্থকও হয়েছে। সবাই এর পক্ষে-বিপক্ষে বলেই যাচ্ছে। তা আমিই বা বাদ যাবো কেন? আমিও কিছু বলে যাই।

এখানে আমার বলা জরুরি কারণ আমি ঐ সকল নারীর হয়ে কথা বলবো যাদের তথাকথিত ঘর বা সংসার কোন না কোন কারণে করা হয় নাই এবং এটা নিয়ে কোন দুঃখও নাই।

জী, ঠিক শুনেছেন। আমার সংসার নাই, স্বামী নাই, একারণে আমার দুঃখ নাই। আমার এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নাই যে আমি শ্বশুরবাড়ির মধুর হাঁড়ির মিষ্টি খেতে পাচ্ছি না। কারণ বাংলাদেশে এখনও ঘর সামলানোর যে ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের উপর ন্যস্ত। স্বামী বাবাজিরা এখনও ননীর পুতুল হয়েই থাকেন ঘরে। সারাবছর এর মেহমানের মত। ব্যতিক্রম কখনই উদাহরণ নয়। তাই আমি অতীব আনন্দিত যে এই বস্তু আমার নাই। আমি এমন কোন ননীর পুতুল পালতে আগ্রহী নই, তাই নাই।

কিন্তু এই কলুর বলদের মতো খাঁটাখাঁটুনি করার পরেও এখন নতুন উপদ্রব হচ্ছে, মেয়েদের ঘরের কাজ তো থাকছেই, সেখান থেকে তার মুক্তি নেই, তার ওপরে বাইরে কাজ করতে হবে এই ব্যাপারটিকে প্রায় বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এই যে আমাদের নানি দাদি মা খালা এনারা যে চুপচাপ ঘরের কাজ করে যাচ্ছেন এটা যথেষ্ট না। একজন নারীর এখন দুইদিকেই অর্জন থাকতে হবে। নারী স্বাধীনতার সাথে নারীদের ঘর সংসার সামলানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে, তথা ব্যবসা সামলাতে হবে এই ধারণাকে বর্তমানে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।

কিন্তু কেন?

দুইদিকে অর্জন থাকার পরেও এমন অসংখ্য নারী আছেন যারা দিনের পর দিন স্বামীর অন্যায় মেনে নেন, স্বামীর পরকীয়া মেনে নেন, আরও অনেক কিছুই মেনে নেন। কেন নেন? কই থাকে তখন স্বাধীনতা? কেন তারা পারেন না অন্যায়কারী স্বামীকে কোন দ্বিধা ছাড়াই আনন্দিত মনে মুক্তি দিয়ে নিজে ভালো থাকতে?

মায়ার বাঁধন? অভ্যাস? ভালবাসা? সামাজিক প্রয়োজন? সবকিছুর মিশ্রন?

নাকি বছরের পর বছর মাথার মধ্যে এটা প্রোগ্রাম করে দেয়া যে সংসার করতে হবে, এভাবেই করতে হবে, ব্যবসা করুক, কাজ করুক আর না করুক বিয়ে ছাড়া থাকা যাবে না, স্বামী ছাড়া থাকা যাবে না, বাচ্চা জন্ম দিতে হবে, মা হতে হবে, সংসার করতে হবে, সংসার ভাঙ্গা যাবে না যা কিছু হয়ে যাক, কাজ করুক না করুক, ব্যবসা করুক না করুক, নারী কে চলতে হবে সমাজের করে দেয়া প্রোগ্রামের ছকে। এর বাইরে যাওয়া যাবে না।

ভালবাসা আর মায়ার বাঁধন এর কথা বলে বলে রঙ-বেরঙের চুড়ি হাতে পরানো হয়, এরপর সেই চুড়ি হাতকড়া হয়ে কখন বসে যায় কব্জিতে, কালশিটে ফেলে দেয়, এটা কি আদৌ কোন মেয়ে চিন্তা করার সুযোগ পায়? বিয়ে, সংসার, মাতৃত্ব এগুলো নিয়ে ভাবার, এগুলোর দায়িত্ব পালন করা নিয়ে চিন্তা করার আগেই এগুলোতে জড়িয়ে পড়তে হয়।

এই হাতকড়া হাতে না, মগজে পড়ে যায়, চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমি এর কোনো বাংলা নাম পাচ্ছি না। ইংরেজিতে হয়তো বলা যায় ইমোশনাল ম্যানিপুলেশন অফ সোসাইটি। এই ম্যানিপুলেশন এর মধ্য দিয়ে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সব মেয়েকেই যেতে হয়। কয়জন পারে ম্যানিপুলেট না হয়ে থাকতে? কয়জনের মনের জোর থাকে? পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে?

এই গোঁদের উপর এখন বিষফোঁড়া হিসেবে এসেছে, ব্যবসাও সামলাই! আরে জ্বালা!

আমি জীবনের শুরুতে একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর পাইনি। বয়স ৬ কী ৭ বছর ছিল আমার। প্রশ্নটা ছিল, কেন একটা মেয়েকেই বিয়ে করে বাপ মা ভাই বোন সব ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে? কেন সংসারের সব কাজ একটা মেয়েকেই করতে হবে? কেন একটা ছেলেকে এগুলোর কিছুই করতে হবে না? এর কোন যৌক্তিক উত্তর আমি পাইনি আজ পর্যন্ত। আর যেহেতু পাইনি, আমি সুযোগ দেইনি এই সমাজের কোন ম্যানিপুলেশন আমার মগজে গেঁথে বসার।

সামাল দিলাম না ঘর, সামাল দিলাম না ব্যবসা, তাতে কি আমি মানুষ থাকবো না? আমার স্বাধীনতা থাকবে না?

নারী দিবস একটা প্রহসন ছাড়া কিছুই না। প্রতি বছর এই প্রহসনে অনেক অনেক প্রলাপ বকা হয়, কিন্তু শিকড়ের সমস্যাগুলোর কোন সমাধান করে না। যেদিন প্রতিটা মেয়ে সমাজের এই প্রোগ্রাম করার বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবে, নিজের জীবনের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সেদিন বলবো, নারী স্বাধীন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.