ঘরে-বাইরে কাজের সমতা থাকুক, কাজের সমবণ্টন থাকুক

লিপিকা তাপসী:

লেখাটা একটা জোকস দিয়ে শুরু করি।

স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে কাপড় কেঁচে দিতে, স্বামী এটা শুনে হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, স্ত্রী কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে জানায়, উকিলের বাড়ি যাচ্ছে, তার ডিভোর্স চাই। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে কাপড় কাঁচতে বসে। উকিলের সাথে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলে, উকিলের বাসায় গিয়ে দেখে সে বাসন মাজছে। সোশাল মিডিয়ায় এই জোকসে সবাই মজা পায়। এই পুরুষকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তো, যে পুরুষ বাসার কাজ করে সে সমাজের চোখে হাসির পাত্র। তার মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি করে মানুষ। আড়ালে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। অনেক পুরুষ আছে কাপড় ধুলেও ছাদে মেলতে দিতে যায় না। মানুষ তাকে কী বলবে এই ভয়ে। গ্রামে পুরুষ বাইরে থেকে এলে তার খাওয়ার পানি, তোয়ালে হাতের কাছে দিতে হয়। ঘরের কাজ মানেই মেয়েলি কাজ। আর মেয়েলি কাজ যে পুরুষ করে তার মান সম্মান তো নাই-ই।

ঘরের কাজ জানা নারী পুরুষ নির্বিশেষে নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। খাওয়ার জন্য, বসবাসের জন্য ঘরের কাজ জানা জরুরি। এগুলো বেসিক স্কিল। যে এসব জানে সে সকল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে। পুরুষকে এগুলো মেয়েলি কাজ বলে বলে শেখানো হয় না, তারাও শিখতে উৎসাহিত হয় না। সেকারণে কেউ যখন শোনে বউ মারা গেছে, একজন পুরুষ নিজে রান্না করে খায়, মানুষ দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে পারলে তক্ষুণি বিয়ের বন্দোবস্ত করে। সেই পুরুষ বউয়ের কবরের মাটি শুকানোর আগেই বিয়ে করে আরেকজন ঘরের কাজের মানুষ নিয়ে আসে। আর যেই মেয়ে ঘরের কাজ জানে না তাকে চারপাশের মানুষ দুবেলা গুষ্ঠি উদ্ধার করে। নারী যতবড় পদেই থাকুক না কেন রান্না করে খাওয়ায় কিনা তা দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গেলেও তারা আশা নিয়ে থাকে বউ রান্নায় সাহায্য করবে, পরিবেশনে সাহায্য করবে। কোন নারী ধরা যাক উচ্চপদস্থ কর্মকতা, শ্বশুরকুলের কোন আত্মীয় বাড়িতে গেছেন তো আত্মীয়রা খাবার পরিবেশনে, সবজি কাটাকুটিতে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়ে বসে। কিন্ত একই পদের জামাই গেলে শ্বশুরকুলের চৌদ্দগুষ্টি ধন্য হয়ে যায়, কাজের প্রস্তাব দেয়া তো দূরের কথা।

এখন নারীদের বাইরের সাথে কাজের সম্পৃক্ততা বেড়েছে, কিন্ত ঘরের কাজ এখনও অধিকাংশ নারীর ঘাড়েই রয়ে গেছে। যে নারীটি ঘর, বাচ্চা, চাকুরি ব্যবসা সামলায় তার উদাহরণ দিয়ে যে নারী শুধুই চাকুরি কিংবা ব্যবসা সামলায় তাকে নিগ্রহ করা হয় ঘরের কাজ পারে না কিংবা করে না বলে।

আবার যে পুরুষটি অর্থ আয় করে না, তার তো বিয়ে করাই দায়, কেউ বিয়ে করতে চায় না, কোন নারী বলতে চায় না তার স্বামী অর্থ উপার্জন করে না। পরিবারের কাছে তার নিগ্রহের শেষ নেই। নারীকে যাই করুক না কেন ঘরের কাজ দিয়ে বিবেচনা করা হয়, আর পুরুষকে অর্থ দিয়ে। তবে এখন যে মেয়ে ঘরের কাজ, আবার চাকুরি ব্যবসা সামলায় তার তো সেই ডিমান্ড। সেই আদর্শ নারী। তাদের চাপে আমার মতো ঘরের কাজ করতে না চাওয়া, না করা নারীরা ব্যাপক চিপায় পড়ে।

যে ঘর, ব্যবসা, চাকুরি একসাথে সামলাতে পারে কেউ কি খোঁজ রাখে তার নিজের জন্য সময় থাকে কিনা? সে পুরুষ হোক আর নারী হোক। ওয়ার্কলোড বলে একটা কথা আছে, কাজ বণ্টন বলে একটা বিষয় আছে। সংসারে এই বণ্টনটুকু সমানভাবে না থাকলে একজনের ঘাড়ে এসে পড়লে তা তার জন্য কতটা প্রেসারের সেটা কি কেউ খোঁজ রাখে?

সংসার একটা যৌথ বিষয়। সেখানে কাজ বণ্টনের ক্ষেত্রে সেই যৌথতা থাকা প্রয়োজন। দুজন বাইরের কাজের সাথে যুক্ত থাকলে ঘরের কাজেও দুজনের সমান অংশগ্রহণ থাকবে। আশেপাশে অনেক পুরুষ আছে যারা ঘর ম্যানেজ করছে। তার হয়তো অর্থ আয় সংক্রান্ত কাজ পছন্দ নয়, আবার নারীর হয়তো বাসা ম্যানেজ করতে ভালো লাগে না, সে তখন পরিবারের অর্থ সংক্রান্ত কাজ করছে। সেই অপশনগুলো সবার জন্য থাকতে হবে। যারা ঘর ও বাইরে সামলায় তাদেরকে মহিমান্বিত করতে গিয়ে যারা পারে না তাদের উপর চাপ তৈরি করা হয়। এমনকি যারা পারেও তাদেরও ব্যক্তিগত সময়, আনন্দ বিসর্জন দিতে উৎসাহিত করা হয়। এই ভালো, আদর্শ হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যায় তাদের ব্যক্তিগত আনন্দ, নিজস্ব সময়, অনেক প্রতিভা।

ঘরে বাইরে কাজের সমতা থাকুক, কাজের সমবণ্টন থাকুক। নারী হোক, পুরুষ হোক যার যেটা ভালো লাগে তা বেছে নেয়ার স্বাধীনতা থাকুক। সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরি হোক।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.