ঘর ও ব্যবসা দুই-ই সামলাই সম্মিলিতভাবে

ড. সাবরিনা স. সেঁজুতি:

এতোদিন যারা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছিলেন বা যারা এখনও বলে আসছেন, এই বিজ্ঞাপন তাদের জন্য। নারী যাবে ঘরের বাইরে, যাক না, ঘরের কাজ সামলে যাক- সেটাই এই বিজ্ঞাপনের মূল বক্তব্য।

আজ যে তরুণী অথবা ছোট্ট মেয়েটি জীবনে কিছু একটা করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়েছে, এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দিলাম, যাই করো মা, ঘর কিন্তু তোমাকেই সামলাতে হবে। তোমার পুরুষ সঙ্গীটি না পুরুষ, না মানুষ, তাকে তুমি আসবাবপত্র ভাবলে ভাবতে পারো, কিন্তু ঘরের কাজে তাকে পাশে ভেবো না। এ-ও এই বিজ্ঞাপনের বক্তব্য- সেটা কেউ বুঝেন, কেউ বুঝতে চান না।

“জলে নেমে গোড়ালী ভেজাবো না”- এই দাবি করা যেমন মূর্খতা, ঘরে থেকে ঘরের কাজ করবো না বা জানবো না সেটাও কি কম মূর্খতা? আপনার আশেপাশে হাতেগোনা কয়জন পুরুষ ঘরের কাজ পারে, বলুন তো? জানি আপনি হয়তো ভাবছেন, আজকাল অনেক তরুণীও ঘরের কাজ পারে না । কিন্তু তাতে করে কি তার ঘরের কাজের দায়িত্ব নাই হয়ে যায়? যায় না। তারা প্রাথমিকভাবে মা, বোন এবং সহায়িকার শরণাপন্ন হন।

কাজ পারুক বা না পারুক, ঘরের পুরুষটি কি ঠিক একইভাবে ঘরের কাজের দায়িত্ব নেন? তিনি কি নিজের ঘরটিকে নিজের ভাবেন? ভাবেন কি ঘর কিংবা সন্তান শুধু মায়ের না? তাই সন্তান লালন-পালন এবং ঘরের কাজের দায়িত্ব সমানভাবে তারও? কোন কারণে বিবাহিত সম্পর্কের ইতি টানতে হলে, বউকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করার সময় কিন্তু ঘরটা পুরুষের। কিংবা বউয়ের গোসসা হলে ব্যাগ গুছিয়ে স্বামীকে বলে, যাও থাকবো না তোমার সাথে, গেলাম আমি বাপের বাড়ি – তখনও ঘরটা পুরুষের, শুধু কাজের সময় ঘরটা নারীর। বিষয়টা কেমন জানি মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক মনে হচ্ছে না আপনাদের কাছে?

সারা বছর কাজ করে শ্রমিক, কিন্তু বছর শেষে মুনাফা গোনে মালিক। মালিক চাইলেই শ্রমিককে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। শ্রমিকের না পোষালে সেও কারখানা ছেড়ে বের হয়ে যেতে পারে। যাই ঘটুক, শ্রমিকের ঘামে ভেজা কারখানায় তার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না কখনোই। উন্নত দেশে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের অনেক পথ আছে, তেমনি নারীর আধিকার রক্ষার পথগুলোও সেখানে পরিষ্কার। বাংলাদেশে যেমন শ্রমিকের মুল্য নেই, তেমনি নেই ঘরের বউয়েরও ।

নারী ঘরের বাইরে ব্যবসা চালাক, দশটা ডিগ্রী পাশ করুক, কিছুই যায় আসে না, ঘরে সে শ্রমিক বৈ আর কিছু না। তবে এই বিষয়ে তর্ক হতে পারে যদি কথা হয় সিঙ্গেল প্যারেন্টদের নিয়ে। আমি সবসময়ই মনে করি সিঙ্গেল প্যারেন্টরা আসলে দুইজনের কাজ করেন। তারা আক্ষরিক অর্থেই ঘরও সামলান, বাইরেও কাজ করেন। সেটা ব্যবসা হতে পারে, অফিস হতে পারে, হতে পারে কারখানার শ্রমিক। কিন্তু যে পরিবারের নারী-পুরুষ অর্থাৎ বাবা-মা উভয়ের বসবাস, সেই পরিবারে ঘরের সব দায়িত্ব নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক।

ঘরের কাজে নারীর আর বাইরের কাজে পুরুষ- কর্মবণ্টনের এই ব্যবহারিকতা বহু বহু বছর আগে জীবনটাকে সহজ করতে সৃষ্টি হয়েছিল বলেই আমার ধারণা। এটা সহজ কর্মপরিকল্পনাও বটে। অনেক অনেক বছর এই কর্ম পরিকল্পনা আমাদের জন্য ফলপ্রসুও ছিলো। কিন্তু সমাজে পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। যে সমাজে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে না, সে সমাজ স্থবির হয়ে যায়। যুগের সাথে পিছিয়ে পড়ে। আর সেকারণেই নারী ঘরে বন্দী থাকবে না, সেই একই কারণে পুরুষের কর্মক্ষেত্র শুধু ঘরের বাইরে থাকবে না চিরজীবন।

আমি আমার জীবনে অনেক পুরুষ দেখেছি যারা ঘরের কাজে বেশ পারদর্শী। যারা ঘর এবং সংসার দুটোই সামলে চলেছেন সমান তালে। তবে আমার অভিজ্ঞতায় তাদের সংখ্যা কম। অন্যদিকে বহু নারী দেখেছি যারা ঘরে-বাইরে দুই কাজেই ভীষণ পারদর্শী। কে কোন কাজে পারদর্শী হবে সেটা নির্ভর করে তার দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের উপর। আর প্রশিক্ষণ দেবার দায়িত্বটি বর্তায় বাবা-মায়ের উপর। তাই, হ্যাঁ, আপনাকে বলছি, আপনার ঘরে ছেলেমেয়ে যেই সন্তানই থাকুক না কেন, তাকে বেঁচে থাকার প্রশিক্ষণ অর্থাৎ ঘরের কাজ শেখান, যেন আজ থেকে বিশ বছর পর আমরা বলতে পারি আমাদের নারী-পুরুষ উভয়ই “ঘর সামলায়, ব্যবসাও সামলায়”।

ড. সাবরিনা স. সেঁজুতি
শিক্ষক, অস্ট্রেলিয়া নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি

শেয়ার করুন: