আহমেদ মুশফিকা নাজনীন:
স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছে। স্বামী, স্ত্রীর একটা ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে কপালে ঢিল মেরে প্রাকটিস করছিলো। কিন্তু কপালে লাগাতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলো। এমন সময় স্ত্রীর ফোন, কী করছো ? স্বামী: তোমাকে মিস করছি।
সুপ্রিয় পাঠক, ফেসবুকে এই জোকসটা আইটি ফার্মের এক চেয়ারম্যান তার পেজে পোস্ট করেছেন। এই পোস্ট পড়ে লাইক, কমেন্টস আর হাসির ইমোতে তার পেজ ছড়াছড়ি। নানা মুখরোচক মন্তব্য লিখেছেন পাঠকরা। যেন মনে হচ্ছে খুব হাসির একটা কথা শেয়ার করা হয়েছে।
অবাক হলাম। সাথে কষ্টও লাগলো। জোকসে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কী পরিমাণ রাগ আর ঘৃণার বহি:প্রকাশ। স্ত্রী নেই, সেই সুযোগে তার ছবিতে ঢিল মেরে রাগ কমাচ্ছেন স্বামী। মনে হলো, এতোই যখন রাগ ঘৃণা স্ত্রীর উপর তখন সেই স্ত্রীর সাথে সংসার করার কী দরকার! বিষয়টি খুব ফান হিসেবে নিলেও আসলেও কি ফানের ? একটা খারাপ বার্তা কি ছড়িয়ে পড়ছে না সমাজে ?
যে স্ত্রী সারাদিন রাত খেটে আপনার ও আপনাদের দুজনের সংসার দেখেন। সবাইকে মায়া মমতায় জড়িয়ে সংসারটাকে গুছিয়ে রাখেন। নিজে বাসী খাবার খেয়ে, কখনো আধপেটা কখনোবা সংসারের প্রয়োজনে উপোস থেকে হাসিমুখে সবার খাবার রাঁধেন, তার কারণে সবাই সুস্থ থাকেন, তাকে কি হেয় না করলেই নয়? আপনি যখন অসুস্থ হন সারারাত আপনার সেবা করেন হাসিমুখে। সন্তানদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে তাদের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, এই ঢিল কি তার প্রাপ্য?
সুপ্রিয় পুরুষ পাঠক, এই জোকসগুলোতে হাসির ইমো বা হেয় করে কমেন্টস লেখার সময় আপনার কি একবার হলেও আপনার মা, বোন, স্ত্রী, বন্ধু কিংবা ছোট্ট মেয়েটার কথা মনে পড়লো না ? নাকি তারা এর বাইরে ?
আসলে আমাদের চরিত্র হয়ে গেছে অন্যদের হেয় করতে দেখলে আমরা খুব মজা পাই, হাসি। কিন্তু যখন সেই ঘটনাটা নিজের সাথে ঘটে তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়ি।
লক্ষ্য করলাম ফেসবুক পেজে নারীদের হেয় করে প্রচুর জোকস লেখা হয়। সে জোকসগুলো পুরুষরা খুব দ্রুত শেয়ার করেন তাদের পেজে অথবা ইনবক্স থেকে ইনবক্সে। যেন নারীদের হেয় করে লেখা জোকস খুবই হাসির মজার উপাদেয়। এগুলো অনায়াসে শেয়ার করে বন্ধুমহলে বাহবা নেয়া যায়।
একটু খেয়াল করে দেখবেন জোকসগুলোর বেশির ভাগই নারী চরিত্রের নেতিবাচক বিষয় নিয়ে লেখা হয়। বুঝানো হয় নারীদের জন্যই সমাজে যত অশান্তি। মেয়েদের বিয়ে করে জীবনে যত ঝামেলা আসে, স্বাধীনতা শেষ হয়; এদের মাথায় বুদ্ধি নাই, এরা কুটনি, বাচাল, ঝগড়াটে, ছলনাময়ী,লোভী, পরশ্রীকাতর, বেহিসেবী, পরকিয়ায় আসক্ত ইত্যাদি।
আরেকটা জোকসের গল্প বলি… একজন তার ফেসবুক পেজে দিয়েছেন।
‘যখনই ভাবি আজ থেকে সত্যি কথা বলবো, তখনই বউ জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে ? আমি কি খুব মোটা হয়ে যাচ্ছি ?
এই জোকসেও হাসির ইমোর ছড়াছড়ি। প্রশ্ন পাঠকদের কাছে, বউ যদি বরকে ভালোবেসে জিজ্ঞেসই করে আমাকে কেমন লাগছে ? তাতে দোষের কী? বউ কি মোটা হতে পারে না? কালো, শ্যামলা হতে পারে না? মোটা মেয়েরা কি সুন্দর না? বউকেই কেন শুধু দিপীকা, আনুশকা, ক্যাটরিনা, আলিয়া ভাট হতে হবে? কেন তাকে দশভূজা হতে হবে আপনার জন্য ? মানুষ কেন না?
সব স্বামীরাই কি দেখতে সুদর্শন? কালো মোটা, ভুঁড়িওয়ালা, টাক মাথা, বেঁটে ছেলে কি জগত সংসারে নেই?
যিনি এই ধরনের জোকস শেয়ার করেছেন তিনিই কি দেখতে খুবই সুদর্শন? বউ যদি আপনার মতো কালো মোটা, ভুঁড়িওয়ালা, টাক মাথা, বেঁটে ছেলেকে না চেয়ে রনভীর সিং, রনভীর কাপুর, শাহরুখ, টাইগার, রাজকুমার রাউকে চায়? তখন? আপনি কি তাই? একবার নিজের দিকে, নিজের চেহারার দিকে খেয়াল করেছেন কখনও? করেননি। কারণ আপনি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে আছেন।
সুন্দরের ব্যাখ্যা আসলে কী? সুন্দর শুধু নারীদেরই হতে হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে? পুরুষরা যাচ্ছে তাই হলেই হবে?
আরেকটা জোকস পড়লাম।
কানুর বউ মারা গেছে। শোকসভায় বন্ধু কমল এসেছে। কমল জিজ্ঞেস করলো, কীভাবে হলো? কানু: সকালে চা থেকে খেতে হঠাৎ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। কমল কিছুটা নীরবতার পর বললো, ঐ চা-পাতা আর কি আছে?
এই জোকসের নিচে একজন পাঠক লিখেছেন, কমলের ঠিকানাটা দিলে অনেকের সুবিধা হতো বস। আরেকজন হাসির ইমো দিয়ে লিখেছেন, দু:খের শেষ নাই, কমলদার বউ বিষ খেয়েও মরে না।
এই ধরনের সস্তা জোকসগুলো সমাজে কি বার্তা ছড়াচ্ছে, একবার ভেবে দেখবেন কি? বউ মরে যাওয়াটা কি খুব কাম্য আপনাদের? আরেকটা বিয়ে করবেন? সেও তো নারী, সেও তো মারা যাবে। তারও কি মৃত্যু কামনা করবেন? এতো যখন বউকে পছন্দ না, বিচ্ছেদে চলে যান। একসাথে থাকার দিব্যি কে দিয়েছে? ভাবতেই দমবন্ধ লাগছে, আপনার জন্য যে ভালোবাসা মমতা নিয়ে পথ চেয়ে থাকে আপনি তার মৃত্যু কামনা করছেন? হা হা করে হাসির ইমো দিচ্ছেন। গভীরভাবে ভাবছেন না বার্তাটা।
এক জোকসে বলছে, ‘আচ্ছা বাবু, তুমি আমাকে রানী ডাকো কেন?’ ‘চাকরানী অনেক লম্বা তো তাই সংক্ষেপে রানী ডাকি’। কী অদ্ভুত কথা! এমন রুচিহীন কথায় হাসি আসে কীভাবে আপনাদের? এমন সব রুচিহীন জোকস শেয়ার হয় কীভাবে?
কাল ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আপনাদের অনেকের ফেসবুকে নারীকে উইশ করে পেজ জুড়ে থাকবে খুব সুন্দর সুন্দর সব কথা। নিজের মেয়ের, স্ত্রীর ছবি দিয়ে অনেকেই তাদের আলোকিত মানুষ হওয়ার আহবান জানাবেন। সবার কাছে শুভাশিসও চাইবেন। নানা বাণীধর্মী কথা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চাইবেন, আপনি অত্যন্ত শুভাকাংখী নারীদের প্রতি। অফিসে ফুল-কার্ড দিবেন নারী সহকর্মীদের। কেক কাটবেন। হাসিমুখে ঘাড় ঘুরিয়ে ছবিও তুলবেন।
এরপরই আপনার মতো কিছু কথিত আলোকিত মানুষরা ইনবক্স থেকে ইনবক্সে বন্ধু সহকর্মীদের কাছে পাঠাবেন নারীদের নিয়ে বাজে ছবি, নোংরা জোকস। আপনাদের পাঠানো জোকসগুলো শেয়ার হতে থাকবে এক গ্রুপ থেকে আরেক গ্রুপে। একজনের থেকে আরেকজনের পেজে। হাজার লক্ষ মানুষের কাছে তা ঘুরতে থাকবে।
এতে এক শ্রেণির কিছু পুরুষ বিকৃত আনন্দ পেলেও জানবেন এর ভয়াবহতা কিন্তু মারাত্মক। আপনার কারণেই নারীদের প্রতি এক ধরনের সহিংসতা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে সংসার থেকে সমাজে। যার ফলাফল কখনোই ভালো বয়ে আনে না, আনবে না। জানবেন আপনি আজ যে অন্যায় করছেন নারীদের সম্মান না করে, তা একদিন আপনার দিকে ভয়ংকরভাবে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে।
আসতেই হবে।