নারীকে ‘সুপারওম্যান’ হিসেবে দেখানো বন্ধ হোক

ইসাবেল রোজ:

গ্রামীন ফোনের একটি বিজ্ঞাপন রাতারাতি বাম্পার হিট হয়ে গেছে। একজন নারীর ছবি দিয়ে লিখে দেয়া হয়েছে ঘর, ব্যবসা দুটোই সামলান তিনি। ছবিটাতে অনেকেই সমস্যা দেখেননি, আবার দেখেছেনও। ছবিটাতে কী থাকলে কোন সমস্যা মনে হতো না? ছবিটাতে নারী, পুরুষ উভয়ে থাকলে কোন সমস্যা হতো না, ট্রান্স জেন্ডার থাকলে আরও বেশি ইনক্লুসিভ হতো। কিন্তু ছবিতে নারীকে হাইলাইট করা হলো অলরাউন্ডার বা সুপার ওম্যান রূপে।

এতে সমস্যা কী?

১) ঘর এবং ব্যবসা দুটো যেই নারী সামলাচ্ছেন তাকে উপরে তুলতে গিয়ে, যিনি শুধু ঘর সামলাচ্ছেন তাকে অবহেলা করা হয়ে যাচ্ছে নাতো? ‘হোম মেকার’ হওয়াটা লজ্জার বা ডিগ্রেডিং কোন বিষয় নয়। ‘যেই বাচ্চাটার শরীর অসুস্থ হলে শুধু মায়ের বুকে থাকতে চায়, আর সেই মায়ের ঠিক ওইদিনেই এটেন্ড করতে হয় জরুরি মিটিং’- এ,  সেই মাকে যেন কটাক্ষ না করা হয় যে অমুকে ঘর, ব্যবসা দুটোই সামলাচ্ছে, তুমি পারো না কেন, এই বলে। যেই গার্মেন্টস কর্মীর রাতে ঘরে ফিরে ভাত রেঁধে বাচ্চাদের খাওয়াতে হয়, একদিন একটু ফিরতে দেরি হলে যেন তাকে শুনতে না হয় পাশের ঘরের প্রতিবেশীর বউ ঘরে এসে ভাত রেঁধে, খেয়ে নিতে পারলে সে পারে না ক্যান?

২) ঘর সামলানো অর্থ শুধু ঘরবাড়ি পরিস্কার, আর রান্নার কাজ না, ঘর সামলানো মানে বাচ্চা পালন করাও বোঝায়। একটি সংসারে ‘ঘর’ এবং ‘বাচ্চা’ দুজনার হয়। ঘর এবং বাচ্চা দুজনার হলেও প্রত্যাশা করা হয় শুধু একজন এর দেখভাল করবে!! অথচ দুজন মিলেই কিন্তু ঘর এবং বাচ্চা পালন করা যায়। যে কাজ নারী-পুরুষ উভয়ই করতে সক্ষম, শুধু নির্দিষ্ট একটি জেন্ডারের মানুষকে কেন ‘ঘর’ এবং ‘ব্যবসা’ সামলানোর ক্ষেত্রে হাইলাইট করা হচ্ছে?

৩) মেয়েরা ঘরের কাজে পারদর্শী হোক আর না হোক , ধরেই নেয়া হয় ঘর সামলানো মেয়েদের ডিপার্টমেন্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয়ে থাকে আমার বোন কিছু করে না, মা কিছু করে না, তারা ‘হাউজ ওয়াইফ’। ‘হাউজ ওয়াইফ’ যখন শুধু ঘর সামলায় তখন তাকে আমরা গোনায় ধরি না, কারণ তার কাজের কোন আর্থিক মূল্য কেউ নির্ধারণ করে দেয় না। সেই একই ‘হাউজ ওয়াইফ’ যদি একটা ব্যবসা শুরু করে তখনই তাকে ঘর, ব্যবসা দুটো সামলানোর ক্রেডিট দেয়াটা কতটুকু যৌক্তিক?

যারা ঘরেবাইরে দুইটাই সামলান ভালো কথা, আপনার পাশে যে নারীটি একটা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাদের কথাও একটু চিন্তা করবেন!! নিজের প্রাইড নিয়ে গলাবাজি করাই যায়, তাই বলে অন্যের উপর আপনার উদাহরণ চাপিয়ে দেয়ার কথাটাও একটু মনে রাখা দরকার।
আজ থেকে প্রায় ১৫ বছর আগেকার একটা ঘটনা মনে পড়লো। এক সিনিয়র আপা তখন ইংল্যান্ডে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন। তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন। অবশ্য এদেশে আসার পর তাকে আরও পড়াশোনা করতে হয়েছে আর তার হাজবেন্ড ছিলেন সলিসিটার। আপুর কাছে একটা কাজে গিয়েছিলাম। আপুর বাসায় গিয়ে জেনেছিলাম যে
তিনি ফুলটাইম জব করেন, তাদের একমাত্র মেয়েকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিয়েছেন তার হাজবেন্ড। তার হাজবেন্ড নিজের ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে মেয়েকে বড় করছেন, ঘরের সবকিছু সামলাচ্ছেন, আর আপু আমাদের ন্যাশনাল হেলদ সার্ভিসে ফুলটাইম জব করছেন। যারা ইংল্যান্ডের হেলদ সার্ভিসের সাথে পরিচিত তারা জানে ডাক্তারদের কত ঘন্টা ওভারটাইম করতে হয়!
সেই আপু এবং তার হাজবেন্ড দুজনাই এখন ঘর এবং বাইরে কাজ করেন, তাদের মেয়ের এখন ১৮ বছর হয়ে গেছে।

রিসেন্টলি আমি আরেকজন নারীর সান্নিধ্যে এসেছিলাম, তিনি নতুন মা হয়েছেন। তার হাজবেন্ড নিজের ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে ফুলটাইম বাচ্চাকে দেখাশোনা করবেন বলে রাজী হয়েছেন। বাচ্চা হলে একজনকে স্যাক্রিফাইস করতেই হয়, সেটা আমাদের দেশে যেমন, তেমনি বিশ্বব্যাপী। অনেক দেশেই পুরুষরা অনেক আগে থেকেই এই ত্যাগ স্বীকার করে আসছে। আজকাল আমাদের দেশের কিছু পুরুষও এগিয়ে আসছে, এটা খুবই পজিটিভ। যদিও সংখ্যায় হয়তো কম।

সুতরাং বলছিলাম কী, যেসব মা দুটো সামলাতে পারেন না তাঁরা চাপ নিবেন না। আপনাকে নিজের ঘর এবং বাচ্চাকে প্রায়োরিটি দিতে হলে দিবেন। তবু এসব ফালতু বিজ্ঞাপন দেখে মন খারাপ করবেন না বা হীনমন্যতায় ভুগবেন না। সিংগেল মা এবং বাবা যারা আছেন তাদের জন্য এক্সট্রা স্যালুট, কারণ তাদের অন্য কোন অপশন নেই। তারা ঘর এবং বাহির, দুই জায়গাই সামলাতে বাধ্য। সমাজে তাদের আবার প্রাপ্য ক্রেডিট দেয়া হয় না। তারা সন্তানদের ‘সময়’ অথবা ‘চাহিদা পূরণ’ কোনটাই দিতে সক্ষম হননি। আর নিজেদের ট্রমা বাচ্চাদের উপর নিজের অজান্তেই ছড়িয়ে দিয়েছেন, কারণ আগেই বলেছি যে তাদের অপশন ছিল না যেকোনো একটিতে মনোনিবেশ করার।

আপনি সিংগেল মাদার এবং ব্যবসায়ী? একটু নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন কতজন আপনাকে ক্রেডিট দেয়? নিজের পরিবারের কাছ থেকেই স্বীকৃতি পায় না অনেকেই।

সবশেষে শুধু এটুকু বলবো, আপনার বাস্তবতায় আপনি ঘর, চাকরি, ব্যবসা যতটুকু করতে পারেন এবং নিজের জীবনকে উপভোগ করতে পারেন সেই চেষ্টা করুন। ঘরের কাজ খুব বেসিক কাজ, নারী-পুরুষ প্রতিটা মানুষেরই এই বেসিক কাজ করতে পারা উচিৎ। না পারলে শিখে নেয়া উচিৎ। এখানে মেয়েদের ডিপার্টমেন্ট বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। যাই হোক যার যার নিজের বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে আমরা ভালো থাকার চেষ্টা করি। নারীকে অতিমাত্রায় ক্রেডিট দিয়ে সুপারওম্যান না বানিয়ে যতটুকু তার প্রাপ্য, সেটুকুই নিশ্চিত করি বরং।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.