ঘর সামলাই, বাইরেটাও সামলাই

মনিরা সুলতানা পাপড়ি:

আমি দু’সন্তানের মা। একজন স্পেশাল নিড শিশুও আছে আমার। আমি ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই। এটা তো সত্য। অস্বীকার করবো কী করে?
তবে ঘর এবং ব্যবসা কোনটাই একা সামলাই না। আমার সাথে সমানভাবে বা কখনও বেশি সামলানোর মানুষ আছে।
আমার পার্টনার আমাকে সমান শোল্ডার শেয়ার করে সব কাজে।
কিন্তু যার লোড শেয়ার করবার কেউ নেই, তাকে তো নিজের সামলাতেই হবে। আর সে সামাল দেয়াটাকে তো ছোট করার কোন কারণ বা যুক্তি দেখি না।

তবে হ্যাঁ, এই ঘর সামলাই, সাথে ব্যবসাও সামলাই, বা যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে টাইপ আপাতঃ নিষ্পাপ এই স্কিলগুলোকে গ্যাসলাইটিং করে যারা আগুন জ্বালায় বা সেই আগুনে যাদের আলুপোড়া খাওয়া হয় তাদেরকে নিয়ে ভাবুন না! কাদের সুবিধা হয় নারী যদি রান্নাও করে রাখে, আবার চুলটাও বেঁধে রাখে??
এই ইনোসেন্ট ভালোলাগার ঢেঁকুরটাও পরিশ্রমী মেয়েরা এখন তুলতে পারবে না, কারণ এটাকে ব্যবহার করে অন্য মেয়েদেরকে প্রেশার করা হয় এবং একটা আনরিয়েলিস্টিক গোল এচিভ করবার জন্য ঘোড়া পেটানো অদৃশ্য চাবুক দিয়ে তাদেরকে সেই ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে দেয়া হয়।

একটা ভাইরাল পোস্ট ঘুরছে, “ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই,” এবং চলছে তার প্রতিবাদ। প্রতিবাদে অনেকেই বলছে “আমার ঠেকা নাই,” বা “পারতে আমার বয়েই গেছে” টাইপ। আহা, এই দৃশ্যটা সত্যি যদি হতো,কি ভালোই না লাগতো!
আমার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আমার দেখা ৯৯.৯ টা মধ্যবিত্ত কর্মজীবী নারীদেরই এই সামলানো সামলাতে হচ্ছে মানে বাধ্য হচ্ছে। আগে নারীদের চাকুরীর অনুমতি পাওয়া দুষ্কর ছিলো এখন একটা বাড়তি আয় যখন জীবনে যোগ হলো তখন “বাড়তি আয়” টা ঠিকই ভালো লাগে কিন্তু আয় যে করে তাকে ভালো লাগে না।
যেন সে সংসারের বাইরের এক্সট্রা কাজটা করে অন্যায় করছে তাই ঘরে এসে বা ঘরে যতক্ষণ থাকে সেটার কাভার আপ করতে হাড়ভাংগা খাটুনি খাটতে হয়।

বউ এর বেতনের টাকা ঠিকই ভালো লাগে কিন্তু তার একটা ভুলচুক সহ্য হয় না। কথায় কথায় খোঁটা শুনতে হয়, সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরলে সংসার তো উচ্ছন্নে যাবেই। আর যদি বাচ্চা-কাচ্চার স্কুলের পড়াশোনায় একটু ঘাটতি হয়, তাহলে মাকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে তো হবেই। যেন বাচ্চাটা তার একার। একা একাই জন্ম দিয়েছে!
তো এরকম ঘর-বার যাকে সামলাতে হয়, সে একটু কলার ঝাঁকাতেই পারে! তার না পেরে উপায় কি বলেন তো? সংসার ছাড়বে, বাচ্চাদের ছেড়ে দেবে? না-কি হাতের পাঁচ সবেধন নীলমনি চাকরিটা ছেড়ে দেবে? সেকি আসলে “আমার ঠেকা নাই” বলে সত্যিই গা এলিয়ে দিতে পারে?

আহা যদি পারতো! তাহলে অন্য পাশও দায়িত্ব নেবার জন্য রেডি হতো।

আমার ক্লাসমেট, কলিগ অনেকেই আছে, যাদের ঘরে প্রতিদিন ফ্রেশ রান্না না হলে স্বামী সন্তানের মুখে খাবার রোচে না। এভাবেই শুরু থেকে চক্রটা হয়ে এসেছে। শাশুড়ি তার ঘরে যেভাবে করতে বাধ্য হয়েছে, ছেলের বউকেও সেভাবে করে যেতে হচ্ছে, তার ছেলের বউয়ের জন্যও সে সেই ফাঁদ বানিয়ে রাখছে।

এই চক্রের শেষ কোথায়?

নারীরা এখনো স্বামী সন্তান না খেয়ে থাকবে বা কম খেয়ে উঠে যাবে, এমন দৃশ্য দেখেও পাত্তা না দেয়ার মতো মানসিক জোর কতজন নারী এচিভ করতে পেরেছে আমার জানা নাই।
বাচ্চা একটু কম খেলেই তো মায়েরা রাতে ঘুমায় না। কত মাকে চিনি এমন! ঘরের কাজে সাহায্যকারী থাকলেও রান্নাটা মেয়েদের নিজেরই করে তবে অফিস যেতে হয়, এমন কতজনকে দেখলাম। অফিসেও বেস্ট পারফর্মেন্স দিতে হবে, ঘরেও। কোথাও ছাড় নেই। অফিসে একটু ভুল হলেই বস বলবে, “মেয়ে মানুষকে দিয়ে কি আর অফিস আদালত চলে?”
আর ঘরে কোন ভুল হলে বলবে, “সারাদিন তো বাইরেই কাটিয়ে আসে, সংসার গেলো গোল্লায়!”

আর যদি কোন মেয়ে এভাবে সব সামলাতে না পারে তবে তাকে সেই “সব পারা সব করা” মেয়েটার উদাহরণ দিয়ে চাপ দেয়া হয় যেন সেও এভাবে পারার চেষ্টা শুরু করে দেয়। না পারলে তার জন্যও অপেক্ষা করছে অনেক গ্লানি! তো কোথায় যাবে মেয়েরা?? এ কেমন শাঁখের করাতের জীবন?

তাই এই কলারটা তাকে ঝাঁকাতে দিন প্লিজ। আর যে মেয়েরা এই পারা না পেরে বাঁচতে পারে, সত্যিই যাদের ঠেকা নাই এবং না ঠেকে আরামসে চলতে পারে সে মেয়েদের বলবো “ধন্যি মেয়ে!” সব মেয়েরা যেন এভাবে না ঠেকে না ঠকে মাথা উঁচু করে মাটিতে পা ঠুকে হাঁটতে পারে এই প্রার্থনা আমার নারী দিবসে সব নারীদের জন্য।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.