একটুখানি আলোর দিকে ফেরা

বাসন্তি সাহা:

আমার ১২ বছরের মেয়ে তিস্তা প্রশ্ন করেছিল কয়েকদিন আগে। মা কোন রাইটস পুরুষের আছে যা নারীদের নেই। আমি কাজ করতে করতে ক্যাজুয়ালি উত্তর দিয়েছিলাম আইনের দিক থেকে সবই এক আছে। সংবিধানে সমান অধিকারই দেয়া আছে, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগে অনেক ফারাক, অনেক বৈষম্য। ও কী বুঝলো জানি না। চুপ করে ছিল। কিন্তু আমি উত্তরটা দিয়ে শান্তি পাইনি। খুঁজছিলাম জুতসই কোনো উদাহরণ। ঠিক তার একদিন পরেই এলো সেই যুগান্তকারী হাইকোর্টের রায়। মায়ের অভিভাবক হওয়ার স্বীকৃতি। তখন তাকে বুঝিয়ে বলতে পেরেই তবে শান্তি পেলাম।

মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারতেন না কয়েকদিন আগেও তাই ছিল। এখনও মাত্র একটা মামলার রায়ে এর স্বীকৃতি এসেছে। কয়েক বছর পরে হয়তো আইনও হবে। কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের অহিষ্ণুতা, সহানুভুতিশূন্য দৃষ্টিভঙ্গি যতদিন না দূর হবে ততদিন কেবল আইন কোনো কাজে আসবে না। এখন তো বাবা তবু খরচ দিতে বাধ্য হন সন্তানের, তখন হয়তো মা অভিভাবক বলে খরচের হাত তুলে নেবেন। কতজন মা স্বাবলম্বী আছেন যে নিজের সন্তানের সব খরচ চালিয়ে তাকে লেখাপড়া শেখাতে পারবেন? দায়িত্ব নিতে পারবেন?

সময় পাল্টাচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়েই। কিন্তু মেয়েদের দুভাবে আন্দোলন করতে হয়, নিজেকে তৈরি করার, টিকে থাকার আন্দোলন আর সমাজের রাষ্ট্রের নীতি মনোভাব পরিবর্তনের আন্দোলন। নারীবাদ বা পুরুষতান্ত্রিকতার সাথে নারী হওয়ার সম্পর্ক নেই। দুটোই একটি আদর্শ বা আন্দোলন। কে, কীভাবে আমরা এটাকে ধারণ করি সেটাই মূল বিষয়। মেয়েদের যে ধর্ষণ বা অন্য আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরিচের গুঁড়ো রাখা অথবা তায়কোয়ান্দে ক্যারাটে শেখার গুরুত্ব দেন অনেকে, আমিও মাঝে মাঝে ভাবি, মেয়েকে তায়কোয়ান্দে ভর্তি করাবো। কিন্তু আমাদের মেয়েরা আত্মবিশ্বাসী হলে বা আত্মরক্ষার কৌশল বা কাউকে পাল্টা আঘাত করতে পারলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে না। যতদিন না সমাজ বদলায়, সমাজের মনোভাব বদলায়, ততদিন নারীকে তার শরীরের জন্য দায়ী করা হবে তার পোষাককে দায়ী করা হবে।

আর আজকাল যেটা শুরু হয়েছে কে মোটা কে চিকন আর সুন্দর থাকার অবর্ণনীয় প্রতিযোগিতা, সুন্দরী হওয়া যে আবশ্যিক হয়ে উঠেছে সেটাও তো এক ধরনের শোষণ। সেটাও পিতৃতান্ত্রিকতারই সৃষ্টি, কিন্তু আমরা নারীরা তার বাইরে আসতে পারিনি। সারা পৃথিবীতে নারী শরীরের যে পণ্যায়ন, সেটাও নারীর অবমাননা ও বাণিজ্যিক শোষণ।

যত দিন যাচ্ছে সারা পৃথিবীটা হয়ে যাচ্ছে বাজার। সেখানে নারী এমনকি সব মানুষই পণ্য। যেখানে নৈতিকতার কিছু নেই, সবই পণ্য। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিষয় নেই। মানুষ কেবল ক্রেতা। তাই ইয়াবা, অস্ত্র, আর ধর্মগ্রন্থ সবই অনলাইনে চাইলে কেনা যায়। এই সময়ে নারীকে তাদের রক্ষা করতে হলে কেবল শরীরের শক্তির সাথে সাথে, মেধায় মননে বলীয়ান হতে হবে।

বাংলা সিরিয়াল, কাঁথাস্টিচ, রান্না, শাড়ি, সন্তানের কোচিং এর বাইরে বের হয়ে আসতে হবে। অধিকার কাউকে কেউ এমনি কখনোই দেয়নি, দেবেও না। সেটা অর্জন করেই নিতে হবে। না হলে নারীকে পুরষ্কার হিসেবে মিক্সার বা গ্রাইন্ডারই পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে আরও দু’শ বছর।

ভেবেছিলে বাহুবল কিছু নয়
বুঝি তপোবলে
জিতে নেবে মানুষের ন্যায্য অধিকার—নবনীতা দেবসেন।

বাসন্তি সাহা
সমন্বয়কারী-রির্সাস এ্যান্ড ডকুমেন্টেশন
দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.