মা শুধু ‘গর্ভকালীন শেল্টার হাউজ’ না হোক

সুচিত্রা সরকার:

খুব শোরগোল পড়ে গেছে একটি রায়ে। স্কুলের ফরম বা পাসপোর্টে মা অভিভাবক হিসেবে থাকতে পারবেন এখন থেকে।
বাবাকে পরিচয় দিতে সন্তানদের বা সিঙ্গেল মায়েদের জন্য এটা নিশ্চয়ই সুখবর।

কিন্তু আমার প্রত্যাশা আরো গভীরে প্রোথিত।

সমস্যাটা অনুভব করি মা হবার পর থেকে।
থ্রি স্টার হাসপাতালে বাচ্চার জন্ম হয়। সেখানে বার্থ সার্টিফিকেটের ফরম দেয়া হয়।
আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, বাবার নাম, বাবার স্থায়ী ঠিকানার ঘর আছে। অন্যদিকে মায়ের নামের ঘর। ঠিকানার কোনো ঘর নেই।
লড়াইটা শুরু করি। ডাক্তার, বরের একরকম কলিগ। বললাম, এটা কেমন কথা? ফরম সংশোধন করতে হবে!
জবাব এলো, এখনই এতো চটেছো। বাচ্চার স্কুল, কলেজ সারা জীবনে আরো অবাঞ্ছিত হবার ঘটনা আসবে। তখন কী করবে?
বললাম, ফাইট করবো।

হাসপাতালে গেলাম। তিনটা ভবনের ছয়টা তলা, আটজন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মহাপরিচালককে দরখাস্ত দিতে পারলাম।
তার সঙ্গে কনভারসেশন রেকর্ড করে রেখেছিলাম। তিনি বলেছেন, আমার ঠিকানা লেখার ঘর তখনই দেবেন, যখন আমি সিঙ্গেল মাদার হবো।
মানে, নিজের ঠিকানা লিখতে চাও? সিঙ্গেল মা হয়ে যাও।
উকিলের সঙ্গে কথা বললাম। মামলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। জাস্ট বিশ হাজার টাকার জন্য মামলাটা শুরু করতে পারিনি। করোনার সময় জমানো টাকায় হাত দিতে মন চায়নি।
তারপর জন্মনিবন্ধন করেছি বাচ্চার। সেখানে একটা পরিবর্তন করেছি। বৈপ্লবিক বলা চলে।
বাচ্চার স্থায়ী ঠিকানা কোনটা হতে পারে? বাবার, না মায়ের? কেন দুটোই নয়? বা যেকোনো একটা? কখনো মায়ের বা কখনো বাবার! যেটা মন চায়!
আইন সেইমত নিজে পরিবর্তিত হয়ে যাক!

পাসপোর্ট করলাম। এই মামলার রায়ের আগে। অভিভাবকের নাম বাবার দিলাম। স্থায়ী ঠিকানা আমার বাড়ির। আমার ভাই পিতৃতান্ত্রিক এবং কঠিনরকম পুরুষতান্ত্রিক। বললো, এতো বিল্পবী। ধর্মের ঘরেও নাস্তিকতা লিখে দেন!
বললাম এটা, ওর চয়েজ হবে!
যাই হোক!
স্কুলের ফরমে অভিভাবক শুধু বাবা। অথচ নালন্দায় মা, বাবা দুজনেই ছিল। ফরম পূরণ করে দুজনের নাম দিলাম। দুজনের ছবি একসঙ্গে স্টেপল করে দিলাম।
বললো, দেন, ঠিক আছে।
তবে আমরা বাবারটাই রাখবো।
অথচ বাচ্চাকে ‘মানুষ’ হবার জন্য আমি স্কুলে পাঠিয়েছি।

সম্প্রতি রায়ের ফলে অনেক সমস্যার লাঘব হলো।
কিন্তু তাতে নারীর সম্মানটা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো না।
বাচ্চা জন্মের পর ওর ফাইল যখন আমার হাতে দিলো, আশ্চর্য অনুভূতি হয়েছিলো। নাম লেখা- ‘বেবি অফ সুচিত্রা’।
প্রশ্নাতীতভাবে। কারণ এ আমার গর্ভজাত।
হেলথ এন্ড হোপের ডাক্তার রকিব আমার বাচ্চাকে দেখতো। জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত ওর নাম ঠিক করি নাই। উনি প্রতিবার বলতেন, এখনো নাম ঠিক করলা না?
হেসে প্রেসক্রিপশানে লিখে দিতেন, বেবি অফ সুচিত্রা।
বলতাম, নাম দিলে তো এই পরিচয়টার সুখ আর পাবো না। পরিচিত আর স্নেহের বশে হাসতেন রকিব ভাই।
তারপর নামকরণ হলো। কোনো টাইটেল দেইনি। ও দুই বংশেরই। প্রথাগত ধারায় না। জন্মগত ধারায়। বিজ্ঞান তাই বলে।
আমি বিজ্ঞান মানি।

আরণ্যকের জন্মের পর ব্লিডিং পাস হয়েছিলো কয়েকবার। প্রচুর টেস্টের পর কিছু না পেয়ে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিলো, ওর মামার রক্তের কোনো রোগ আছে কিনা?
বললাম, নেই। তবে ওর বাবার হালকা ব্লিডিং হতো।
ডাক্তার বললো, না, বাবার থেকে বাচ্চার রক্তরোগ হয় না। রক্তের সব স্ট্রাকচার বাচ্চা মামার বংশ থেকে পায় (বেচারা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর, তাই বলতে পারলেন না, মায়ের থেকে পায়। কারণ যে মায়ের ভাই নেই, তার সন্তান রক্তরোগ তো আর মামার থেকে পাবে না)।
তারপর আরণ্যকের হিমোগ্লোবিন কমে গেল হুট করে। ছয় মাস থেকে এখন অবধি তিন বেলা ওষুধ, কচু, আনার, কলিজা দিলে এগারোর উপর উঠে না। ডাক্তার থ্যালাসমিয়ার টেস্ট দিলো। বাহক কিনা জানতে!
দেখলো, না।
তবে জিনেটিক্যালি হিমোগ্লোবিন কম। তখন ডাক্তার আমারও একটা টেস্ট দিলো। কারণ মায়ের থেকেই এটা পায়। দেখা গেল জন্মগতভাবেই আমার হিমোগ্লোবিন কম। সারাজীবনই দশ বা এগারো।

তো, বিজ্ঞান মানবো না?
বিজ্ঞান বলে, মা শুধু গর্ভকালীন শেল্টারহাউজ নয়।
আমার ত্বক উজ্জ্বল শ্যামলা ছিল। চুল সিল্কি এন্ড স্ট্রেইট। পিরিয়ডে মুড সুইং হতো না।
বাচ্চা হবার পর তিনটা জিনিসেই ভয়াবহ ট্রান্সফরমেশন হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে, হরমোন চেইঞ্জের জন্য। বাচ্চার আট-নয় বছর পর্যন্ত এই হরমোনই থাকবে।

তবু দেশের আইনে মা- ‘ফুরুৎকার’, অপাঙতেয়!
আইন হয়েছে, ভালো। তবে রোকেয়ার ‘সুলতানা’স ড্রিম’ পড়তে আর ভালো লাগে না। তেরো বছর বয়স থেকে পড়ছি। আর অপেক্ষা করছি এমন সমাজের। আর কতো!

বয়স তো ম্যালা হইলো। ক্লান্ত লাগে। তারচে মাননীয় আদালত আইনটা আরেকটু মানবতাবাদী করুন। সকল ক্ষেত্রে, সকল পরিস্থিতে মা ও বাবা অভিভাবক হোক। বা মা একাই। বা যেকোনো একজন।
মা জাতিটাকে আর গর্ভকালীন ‘শেল্টারহাউজ’ তকমায় রাইখেন না। রোকেয়াদের চোখের জল ফুরায়ে যাইতেছে!

প্লিজ, মহামান্য!

২৯.১.২০২৩

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.