মায়ের অভিভাবকত্ব: হাইকোর্টের রায় অধিকারের লক্ষণরেখায় কতটা কী?

জয়শ্রী সরকার:

সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে – প্রগতিশীল এ রায় শুনে আমার সেই বন্ধুটির কথা মনে পড়ছে যাকে জন্মের পর পড়শীরা গোবরের টালে পেয়েছিলেন। বোধকরি পিতৃপরিচয় দিতে না পারার শঙ্কা ও পরবর্তী সকল গ্লানি ও লজ্জ্বার কথা ভেবে মা নিজেও দায়িত্ব নিতে পারেনি। মনে আসছে লক্ষ কোটি যৌনকর্মী মা, ধর্ষণের ফলে আসা সন্তানের মা, বীরাঙ্গণা মাসহ সকল সিঙ্গেল মায়েদের কথা; যারা যুগের পর যুগ অবিবেচক, নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থার সাথে লড়াই করে করে ক্ষয়ে গেল, মরে গেল তাদের কথা! এই রায় শুনে না জানী কতজন আনন্দে চোখের জল ফেলছেন। কতজন অভিমানে ঠোঁট ফোলাচ্ছেন। ভাবছেন, আরও আগে কেন এ রায় হলো না!

ভালো লাগছে ভেবে পিতৃপরিচয়হীন অথবা পিতার সাথে জড়িয়ে না থাকতে চাওয়া নারীদের সন্তান নিয়ে মরমে মরে যেতে হবে না, স্কুলে ভর্তি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে না, জগতের সাথে ছলনা করতে হবে না, নির্মম সিস্টেমের ভয়ে নবজাতককে খড়ের ভাঁজে, গোবরের টালে, পথে-ঘাটে-ময়লা-ড্রেনে ফেলে যেতেও হবেনা। যদি, রায় শুধুমাত্র কালিকলমে না থেকে চর্চিত হয় তবে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের শিক্ষালাভের সংকট অন্তত দূর হলো। মানচিত্রের সকল সাম্য-চাতক মানুষের মত হাইকোর্টের এই রায়ে আমারও গর্ব হচ্ছে। যে তিনটি প্রতিষ্ঠান রিট করলেন, ব্লাস্ট, নারীপক্ষ ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি তাদের প্রতি করজোড়ে শ্রদ্ধা জানাই। সেইসাথে ধেই ধেই করে আসা জিজ্ঞাসার তর্জমা চলুক।

এই রায় কি সকলক্ষেত্রে মায়ের অভিভাবকত্বকে নির্দেশ করছে?

হাইকোর্টের রায়ে যতটুকু বুঝলাম, শিক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো কাগজপত্রে অভিভাবকের স্থানে মা অথবা বাবা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম দেয়া যাবে। সুতরাং অভিভাবকের স্থানে যেকোনো একজনের নাম দিয়েও শিক্ষার্থীরা ফরম পূরণ করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে মায়ের নাম লেখায় আর সংকট রইলো না। ২০০৭ সালে বাবার পরিচয় নেই বলে রাজশাহী বোর্ডে যে মেয়েটি এসএসসিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি সেই বৈষ্যমের বিরুদ্ধে উল্লেখিত তিনটি উন্নয়ন সংস্থা থানায় রিট করেন। ১৪ বছর পর গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ এই রায়টি হয়। তবে জমিজমাসহ, পারিবারিক বিভিন্ন ইস্যুতে নারীকে অভিভাবকত্ব দেয়ার বিষয় এই রায়ে কিছু বলা হয়নি এমন মন্তব্যই নজরে পড়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। সর্বক্ষেত্রে মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকার পেতে আরো বহুপথ বাকি ভেবে ক্ষোভ জাগছে। অন্তঃপুর থেকে কেউ একজন বলছে, ধীরে ভগিনি, ধীরে। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। কত অযুত-নিযুত মা-সন্তানের দুর্ভোগ যে লাঘব হবে এই রায় বাস্তবায়ন হলে! এই মহাসত্যের সাথে আমিও একমত। হাইকোর্টের এই রায় কতশত পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে ভয়াল স্রোতে হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাবে। এই রায় কত শত লড়িয়ে মায়েদের শক্তি সঞ্চারক হবে।

তবু জিজ্ঞাসা জাগে, যিনি জন্ম দিলেন তাকে সন্তানের অভিভাকত্ব পেতে লড়াই কেন করতে হবে?

আনন্দিত চিত্তে ধেয়ে আসা প্রসঙ্গগুলো যতই এড়িয়ে যেতে চাইছি, ততই কতকথা যে মনে আসছে। এটা ওটা ভেবে কোথায় যেন চিনচিন করছে। সংসারে, মাঠে ঘাটের কত মায়ের মুখ ভাসছে। যারা সন্তান জন্ম দিয়েও সন্তানের মুখ দেখার জন্য কাঁদছে, বুকে নিয়ে আদর করতে ছটফট করছে, নবজাতককে দুধ খাওয়াতে না পেরে টনটনে বুক নিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে, কিন্তু স্বামী সন্তান দিচ্ছে না-শুধুমাত্র আইনি অভিভাবকত্ব অধিকারের বলে স্ত্রীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সন্তানের দেখভাল না করেও আটকে রেখেছে!

আচ্ছা, আপনাদের নাঈমার কথা মনে আছে? ঐযে সম্পর্কে চির ধরলে সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে দিত না প্রাক্তন স্বামী। কোভিডে সুরক্ষার অজুহাতে সন্তানের মুখটা দেখা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চাকে দেখার আশায় যখন আদালতের কাছে গেল তখনও বাচ্চাকে নিয়ে আসতেন না বাবা। স্বামীর প্রভাব এতো বেশি ছিল যে প্রশাসনকে বলেও কোন লাভ হয়নি। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছেও সাহায্য চেয়েছিল, যেন স্বামী ছেলেকে নিয়ে বিদেশ পাড়ি না দিতে পারে, কিন্তু লাভ হয়নি। একদিন শুনলো বাছাকে নিয়ে প্রাক্তন স্বামী বিদেশ পাড়ি দিয়েছে। এই শোক সইতে পারলেন না নাঈমা। চলে গেলেন। একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো। অন্তর্জালে মিটিংরত মায়ের সাথে ছেলের মধুমাখা একটি ছবি ক্রমাগত ভাসতে থাকলো। হায় হায় পরে গেল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই হায় কন্ডলের মিছিলে আমি, আপনি, আমরা সকলেই সামিল ছিলাম। মনে হতো সব সিস্টেম ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেই। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেম গুঁড়িয়ে দেওয়া তো অত সোজা নয়!

তাই ঘটনার ভাঁজে ঘটনায় কত নাঈমা আসে, যায়! কতজনের খবরই মনে রাখা যায়! নিজেদেরও তো কত ক্ষত আছে, সেখানেও তো প্রলেপ দিতে হয়। সামর্থ্যবান-সামর্থ্যহীন, শিক্ষিত-নিরক্ষর, শহুরে-গ্রামীণ, স্বাবলম্বী-প্রান্তিক সকল নারী শোষিত প্রশ্নে একটি বিন্দুতে মিলে যায়। সময়ের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে গ্রহ থেকে গ্রহের আদি অন্ত জেনে গেল মানুষ। কিন্তু আইন কেবল জানতে পারলো না সন্তানের যত্ন ও আদরে মা তুলনাহীন।

প্রসঙ্গত কথা ওঠে, এমন মাও আছে যিনি সন্তানের প্রতি উদাসীন, সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ও টান কম। আমি শঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছি না। মাতা, পিতা যেই হোক না কেন যিনি অভিভাবক হিসেবে মন্দ, তিনি মন্দ। তিনি অভিভাবক হওয়ার মানদণ্ডে পড়বেন না। অভিভাবক হিসেবে অযোগ্য এবং বিপদজনক। কিন্তু একতরফাভাবে নারী হওয়ার দোষে কেন সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে? অভিভাবকত্ব প্রশ্নে মা বাবা দুইজনকে সমান অধিকার দেয়া হোক। যিনি যোগ্য নয়, তিনি মা বাবা যেই হোক তিনি দায়িত্ব নিতে পারবেন না।

কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-ধর্মগ্রন্থ সবখানে মা বলে পূজা করবে, মাকে বিশ্বাব্রহ্মাণ্ডের সমান বলবে, মাতৃদর্শনই ইশ্বরদর্শন বলে ফেনিল ঢেউ তুলবে, অথচ শর্তসাপেক্ষে জিম্মাদারিত্বের অধিকার থাকলেও অভিভাবকত্বের কোন অধিকার নেই! তাই নাঈমারা লুকিয়ে কাঁদে, নাঈমারা মার খায়, নাঈমারা খুন হয়, নাঈমারা মরে যায়, নাঈমাদের আত্যহত্যা করতে হয়, কিন্তু ইগোপ্রবল সমাজব্যবস্থা পুরুষকেই অভিভাবকের সিংহাসনে বসিয়ে রাখবে।

তাই সন্তানের অভিভাবক প্রশ্নে মায়ের এই স্বীকৃতির পরিধি সর্বক্ষেত্রে হতে হবে। সন্তানের দায়িত্ব বাবাই শুধু নিতে পারে সে লক্ষণরেখা বহুকাল আগেই নারীরা পেরিয়ে এসেছে। আইনকে সময়ের কথা শুনতেই হবে।

যুগান্তকারী এ রায় সমতার লড়াইয়ে চিলতে আলো। লড়িয়ে নেতৃত্বকেই এগিয়ে আসতে হবে চিলতে আলোকে ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে ভরিয়ে দিতে।

লেখক: কথা সাহিত্যিক, সংস্কৃতি ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.