চিররঞ্জন সরকার:
নূপুর ও আলতা পরা কালো একটা পা। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ক্রিমের একটা টিউব সেই পা দিয়ে চেপে ধরেছে। আর ছিপিহীন টিউব থেকে ক্রিম বের হয়ে যাচ্ছে।
নিচে লেখা: বয়েই গেছে।
এর নিচে লেখা: শুভ কালী পুজো।
থিম, আইডিয়া কিংবা আইডিওলজি হিসেবে এটা চমৎকার। অসাধারণ। ফেসবুকে অনেকেই এই ছবিটা শেয়ার দিয়েছেন।
ছবিটা দেখে আমার বুকটা কেবল খাঁ-খাঁ করেছে। সত্যিই কি ‘বয়েই গেছে?’
আমাদের দেশে কয়জন কালো মেয়ে এমন প্রচলিত সৌন্দর্যতত্ত্বকে পায়ে মাড়িয়ে বলতে পারেন ‘বয়েই গেছে?’
উলটোই বরং বেশি দেখেছি। এখনও দেখছি অসংখ্য কালো মেয়ের নীরবে মরে যাবার মর্মান্তিক সব ঘটনা।
কালো মেয়ে নিয়ে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উক্তি করেছিলেন সম্ভবত শরৎচন্দ্র। বাঙালি আটপৌরে ঘরের কালো মেয়ের যুগযন্ত্রণার ক্লাসিক প্রতীক হয়ে ওঠে শরৎচন্দ্র রচিত ‘অরক্ষণীয়া’র জ্ঞানদা৷ শুরুতেই শোনা যায় মা দুর্গামণির আক্ষেপ, ‘হতভাগীকে আমার কোলেই যদি পাঠালে, রংটা একটু ফরসা করেই পাঠালে না কেন?’ ম্যালেরিয়ায় ভুগে মামার বাড়ি থেকে ফেরার পরেই জেঠিমা স্বর্ণমঞ্জরীর বাক্যবাণ- ‘গায়ের চামড়াটাও কি তোর মামা-মামীরা ছ্যাঁকা দিয়ে পুড়িয়েচে নাকি লো?’ সংসারে আশ্রিতা তেরো বছরের অনূঢ়া মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতে না পেরে নাজেহাল কাকা অনাথনাথ বলে ওঠেন, ‘ঘাটের মড়াও যে এ শকুনিকে বিয়ে করতে চায় না৷’
জ্ঞানদা যেন বাংলার দুখিনী কালো মেয়ের ‘ভাস্কর্য’ হয়ে আছে!
রবীন্দ্রনাথ কালো মেয়েকে নিয়ে তুমুল রোমান্টিকতা-মাখা কবিতা লিখেছেন। ময়নাপাড়ার এক অনাম্নী ‘কৃষ্ণকলি’র বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, কালোত্ব শুধু নারীর অবয়বে নয়, প্রকৃতিতেও পরিব্যাপ্ত। অতএব, ‘ঘন মেঘে আঁধার’, ‘শ্যামল দু’টি গাই’, ‘কালো কাজল মেঘ’৷ বারংবার উচ্চারিত হয় একটিই প্রশ্ন- ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক’৷ নিহিতার্থটি সরল৷ যদিও কন্যাটি শ্যামবর্ণ, তা সত্ত্বেও কবির এই ভালো-লাগা৷
কিন্তু রোমান্টিকতার সব কিছুই বড়ো আলগা-আলগা৷ দিনের শেষে পড়ে থাকে স্রেফ ‘কালো হরিণ-চোখ’টি৷ বাকি ক্যানভাসে ব্যঞ্জনাহীন শূন্যতা৷
শপিং মল ও বিউটি পার্লারে কালো রঙের মেয়েকে সাধারণত কাজে রাখা হয় না। নিলেও অপেক্ষাকৃত কম পয়সায় রাজি করানো হয়। কালো মেয়ের বন্ধু-বান্ধবী কম। অনেকেই টিটকিরি দেয়: ‘‘বাজারে তো ফর্সা হওয়ার অনেক ক্রিম আছে। সেগুলো একটু ট্রাই করতে পারো না? কৃষ্ণবর্ণের কারণে অপমানিত হওয়া ও বঞ্চনার শিকার হওয়ার ঘটনা আমাদের সমাজে খুব কি কমেছে?
কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না—এমন ঘটনায় ভরা গাঁ-গঞ্জ। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ গান শুনে বাহবা দিলেও শব্দে ও বাক্যে তেমন আস্থা রাখতে পারেননি কেউই। ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘‘কালো, কিন্তু দেখতে খারাপ নয়।’’ অনেকে আবার বলেন, ‘‘কালোতে আপত্তি নেই।’’ মানে তিনি যেন বিরাট উদারতার পরিচয় দিতে পেরে ব্যতিক্রমী। গাত্রবর্ণ নিয়ে কৃষ্ণকলিদের কপালে লেখা অন্তহীন লাঞ্ছনা। তবুও তাঁদের হরিণ চোখের আবেদন নিয়ে টানা-হেঁচড়া চলে যুগে যুগে। কাব্য ও সঙ্গীতে কৃষ্ণা ও শ্যামলীদের সামান্য ছাড় দিলেও বাস্তবে বেশিরভাগ মানুষের মনে শুধু গৌরীদেরই জয়। কালো মানেই যেন আপত্তিকর। দেখে গা গুলিয়ে যায় অনেকের। অসহ্য লাগার কারণে দৃষ্টিও সরিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। কালো মেয়ে স্ত্রী হয়, মা হয়। কিন্তু ‘কালো’ বিশেষণ কিছুতেই সরে না।
সভ্য সমাজের শিক্ষিতরাও বলেন, ‘‘ওই যে, কালো মেয়েটার বিয়ে হল!’’ কখনও ভেসে আসে, ‘‘ওই যে, কালো করে মেয়েটা। চিনতে পারছিস না? একদম কালো কুচকুচে! এক্কেবারে আলকাতরা!’’ কেউ বলেন, ‘‘মানুষ কী করে এত কালো হয়? ঠিক যেন দাঁড়কাক! বাপরে কালো!’’ বাড়িতে সকলেই উপদেশ দেন, ‘‘তুই কালো তো কী হল? পড়াশোনা করে দেখিয়ে দে! কালো জগতের আলো।’’ আবার কখনও বলেন ‘‘অনেক কালো মেয়েদের ভালো বিয়ে হয়, জানিস?’’ কিন্তু ওই অপমানটা? সেটা কি হজম করে নিতে শিখতে হবে? তখন শুনতে হয়, ‘‘লোকের মুখে কি আর হাত দেওয়া যায়? কালোকে কালো বললে রাগ কেন?’’ এক ধাপ এগিয়ে কেউ বলে ফেলেন, ‘‘গুগল সার্চ করে দেখ! কত কালো মেয়ে সেরা মডেল। তারা দুনিয়া কাঁপাচ্ছে।’’ কিন্তু কালো বলে অস্তিত্বের অপমান হবে কেন? মনোবল হারিয়ে কুঁকড়ে জীবন যাপন কেন? অপ্রিয় প্রশ্নের সামনে সব কণ্ঠই রুদ্ধ।
কালোরা আড়ালে কাঁদে। ‘আমার রং আমার পরিচয় নয়। রঙের দায় জিনের’— এমনটা বলে সটান মাথা উঁচু করে ওঁরা পথের ধুলো ওড়াতে যে শেখেনি!
ভারতের এক ‘কালো মেয়ে’ লিখেছিলেন ‘আই হ্যাভ নেভার বিন (আন) হ্যাপিয়ার’ নামে বই। এই বইয়ের একাধিক মর্মান্তিক বিবরণে তিনি জানিয়েছেন, মেয়েরা কেমন করে মনে মরে যায়। নিজের অর্পিত কালো রং কী ভাবে অর্জিত সব ক্ষমতার সমাধি দেয়। চারপাশের মানুষ এর নানা ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন না। কেননা কালো মেয়েকে নিয়ে কটাক্ষ করাটাই যেন স্বাভাবিক।
কালো মেয়ে জন্মালে মা-বাবা লজ্জা পেতে থাকেন। মেয়ের কালো মুখ দেখে পরিবারে মড়াকান্না শুরু হয়ে যায়। কন্যাসন্তান বেঁচে থাকার চেয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ কালো মেয়ের পাত্র খোঁজা। জন্ম দিয়ে মা কাঁদতে থাকেন, ‘‘আমার পেটের মেয়ে এমন কালো?’’ বাবারও মাথায় হাত! অনেকেই সহানুভূতি দেখাতে বলেন, ‘‘ওর বাবাটা এত ভালো লোক! লাক খারাপ। তাই মেয়েটা এমন কালো হয়ে গেল।’’ আত্মীয়েরা সান্ত্বনা দেয়, ‘‘বড় হলে এত কালো থাকবে না!”
কালো মেয়ের জন্য রং বেঁধে দেওয়া হয়। অফ হোয়াইট, হালকা গোলাপি, হালকা বেগুনি। লিপস্টিক দিলে নাকি ‘মা কালী’-র মতো লাগে। আর কালো জামা পরলে ভূতের মতো। কালোদের কুঁকড়ে থাকতে দেখলেই খুশি সবাই। রুখে দাঁড়ালেই শুনতে হয়, ‘তেজ কত! কালো না হলে যে কী করত!’ কালোদের দুখি দেখতে চায় সমাজ। খুব বেশি প্রাণবন্ত হলে নজর কাড়ে সকলের! অনেকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করে বলেন, ‘‘কই, তুমি তো তেমন কালো নও! আমি তো জীবনে তোমার চেয়ে অনেক কালো মেয়ে দেখেছি।’’ স্মরণে আনার জন্য পাশের কাউকে সাক্ষী মেনে বলেন, ‘‘ওই যে মনে আছে, সেই কালো মেয়েটা! ঠিক শরীফের কালো ছাতার মতো রং।’’
কালো মেয়ে কেঁদে উঠলেই ফুঁসে ওঠেন দাদী-নানীরা, ‘‘চুপ কর! কিসের দেমাক! তুই কি সুন্দরী? কপাল খারাপ না হলে কি এমন কালো মেয়ে জন্ম দেয় কেউ?” ইশারা কালো মেয়ের মায়ের দিকে। বংশগতি ও জিনের সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নস্যাৎ করে কালো মেয়ের মা হয়ে যান প্রধান ভিলেন। জবাবদিহি তাঁকেই করতে হবে। কিন্তু কার কাছে? অবশেষে মায়ের ভালোবাসা হারাতে শুরু করে কালো মেয়ে। বিরাট এক প্রশ্ন তার সামনে এসে দাঁড়ায়— সে আসলে কে? কালো মেয়ে নাকি মানুষ?