তুলনা বা প্রতিযোগিতা করে ভালো থাকা যায় না

দিনা ফেরদৌস:

বাইরে থেকে দেখলে সবার সংসারই প্রেমে পরিপূর্ণ, গোছানো, সুন্দর মনে হয়। নিজেকে বাদ দিয়ে আর সকলেই প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে সংসার করছে। নিজেকে বাদ দিয়ে বললাম এইজন্যে যে, আমরা শুধু নিজের খবরটাই জানি, অন্যদেরটা জানি না অথবা তারা জানতে দেয় না বলেই ধরে নেই সকলে ভালো আছে। ভালো থাকাটা এমন এক ব্যাপার, যেখানে কারও বলায় বা ভাবায় কিছুই যায় আসে না। ভালো থাকলে বলতে হয় না, চালচলন দেখেই মানুষ বুঝতে পারে। অন্যে যে বুঝতে পারছে তা আপনিও বুঝতে পারবেন। যখন দেখবেন আপনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বা শুনিয়ে কিছু লোক তাদের সুখের বিষয়গুলো প্রদর্শন করছে। যার তার সাথে তুলনা করবে আপনার সংসারের। এমন কিছু আপনাকে শোনাবে যে আপনিও মনের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা অনুভব করবেন। এই করেই তারা আপনার প্রকৃত সুখে বা শান্তিতে পানি ঢেলে দিবে।

আমার এক বান্ধবী কারও সাথে দেখা হলেই তার বরের গল্প শুরু করে দিত এমনভাবে যাতে করে অন্যরা তার ভালো থাকাটা দেখে আফসোস করে। যার জন্যে সে একবার সব বান্ধবীদের নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে। প্রতিদিন বরকে নিয়ে নানারকম ছবি শেয়ার করতো, কোথাও যাবার ছবি, বর তাকে রান্না করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। উপলক্ষ তো আছেই, উপলক্ষ ছাড়াও তাকে এই সেই গিফট দিচ্ছেন, বলা যায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় ছবি দিতেই থাকতো। এই সিনেমা হলে যাচ্ছে তো ওই রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে। এরমধ্যে অন্য কেউ যদি তার একটা ভালো মুহূর্তের ছবি দিত, সাথে সাথে সে প্রতিযোগিতা করে নিজের আরও বেশি রোমান্টিক ছবি দিত। কেউ অসুস্থ আছে এমন ছবি পোস্ট করলেও সে বসে বসে পিঠা খাচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছে এইসব ছবি দিত। অনেকে পিছনে তাকে অসুস্থ বলতো। তার বিয়ে একটু দেরিতে হয়েছিল। আমাদের বিয়ে তার অনেক আগে হওয়ায় আমরা সকলেই বাচ্চাকাচ্চার মা। দুজন দুজনার হয়ে সময় পার করে এসেছি বহু আগে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পোস্ট করার মতো ছবি তোলার সময় যেমন ছিল না, তেমনি সকলের বরের মানসিকতাও এক রকম হয় না যে, খাইতে, নাইতে, ঘুমাইতে,…. করতে ছবি দেবে। একেকজনের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ একেক রকম। একেকজনের সম্পর্কের ধরন একেক রকম।

আর দুইদিন পর পর উপহার দেয়া কিংবা রেস্টুরেন্টে সব সময় খাওয়ার সামর্থ্যও সকলের সমান নেই। আমাদের অনেকেই এই অতি বাড়াবাড়ি দেখে বলতো, দেখ গিয়ে কোন সমস্যা নিয়ে আছে, না হলে এইসব আবার দেখাবার কী আছে! সমস্যা সব সংসারেই থাকে। আমরা কিছুই দেখাই না বলে আমাদের যে সমস্যা নেই, তা নয়। সমস্যা যেমন ঢোল পিটিয়ে মানুষকে জানাতে হয় না, তেমনি সবসময় ফূর্তিতে আছি এটাও দেখাবার কিছু না। ভালো মন্দ কোন কিছুই অন্যদের বেশি দেখাতে নেই বলার কারণ হচ্ছে, আমি এমন অনেক মানুষ দেখেছি, যাদের সাথে আপনি হয়তো একটা সুন্দর কথা শেয়ার করলেন। বললেন, বিবাহ বার্ষিকীতে বর আপনাকে চমৎকার একটা শাড়ি উপহার দিয়েছেন। আরেকজনের এটা সহ্য হবে না, সে গল্প দেবে তার বিবাহবার্ষিকীতে বর তাকে ডায়মন্ডের একটি আংটি উপহার দিয়েছেন। আংটির কথা বলবে যাতে ভালোবাসার তুলনায় গিয়ে আপনি কষ্ট পান। বুঝতে পারেন এখন উপহার হিসেবে শাড়ি টাড়ি যায় না, ডায়মন্ড লাগে৷ এখানে আপনার বর হয়তো তার সর্বোচ্চটাই দিয়েছেন আপনাকে, উনার সামর্থ্য অনুযায়ী। যার বর ডায়মন্ডের আংটি দিয়েছেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী এটা হয়তো খুবই নগণ্য।

আরেকদল আছে আপনি যাদের সাথে কথার কথা আলাপ করবেন আপনার বর শপিং এ যেতে বা রেস্টুরেন্টে খেতে মোটেও পছন্দ করে না। আর আপনি চান বর আপনাকে নিয়ে দুই সপ্তাহে একদিন হলেও বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাক। ওই দলের মানুষ সাথে সাথেই বলবে; কই আমাদের বর তো এমন না। ছুটির দিন ঘরে থাকতেই চায় না। ছুটিরদিন এলেই বলবে আমাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাবে। সারাদিন আমরা বাইরে থাকবো, বাইরে খাবো। সাধারণ একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। ওই দলের মানুষ আপনাকে সেই গল্পই শুনাবে, যেই জায়গাটায় আপনি অভাব বোধ করেন।

নিজের স্বামী সংসার নিয়ে মনে মনে অন্যদের সাথে তুলনা বা প্রতিযোগিতায় যাওয়া মানে হচ্ছে, “সুখে থাকতে ভূতে কিলানো”র মতো। আপনি যাকে বিয়ে করেছেন তার সামর্থ্য নিয়ে ভাববেন সবার আগে। বরের কাছ থেকে যা পাচ্ছেন, তা আপনাকে তৃপ্ত করছে কি না সেটা বড় বিষয়। (এইখানে ভাবার দরকার নেই বর দিবে কেন, নিজেরটা নিজে করলেই তো হয়। এখানে টাকা পয়সা বা গহনাদির কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে ভালোবাসার আদান-প্রদান, যা বেশিরভাগ মানুষ টাকা পয়সা ও সময় দিয়ে বিবেচনা করে। সে আপনি লাখ টাকাই কামাই করে এই সেই কিনেন এই গল্প শোনালে তারাও শুনিয়ে দেবে আমাদের কামাইও আছে, ভালোবাসাও আছে। বর এই দেন, সেই করেন দেখানোর অর্থ হচ্ছে সে কারো কাছে অধিক গুরুত্বপর্ণ, সুখী মানুষ, যা টাকা দিয়ে ক্রয় করা যায় না।

এমনও বহু মানুষ আছে যাদের টাকা পয়সার অভাব নেই শাড়ি, বাড়ি, গাড়ি, গহনা সবই আছে, কিন্তু প্রাণ খুলে গল্প করার মানুষ নেই। দাওয়াত করে মানুষ খাওয়ায় বাড়ি, গাড়ি দেখাতে। কিন্তু একাকী বিকেলে একসাথে বসে চা খাওয়ার মানুষ নেই। অন্যদিকে কেউ হয়তো ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকে। কাউকে দাওয়াত খাওয়াবার সামর্থ্য নেই, ঘরে মেহমান এলে বসতে দেয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কিন্তু দেখা যায়, এরাই বিকেলে একজন আরেকজনকে চা করে দিচ্ছে। দুনিয়ার আবোলতাবোল গল্প করতে করতে একসাথে মুড়িমাখা দিয়ে চা খাচ্ছে। কল্পনা করুন তো দৃশ্যটি। নিজে ভালো থাকলে কী যায় আসে অন্যদের মতো কিছু থাকলে বা না থাকলে।

বহুকাল আগের হিন্দি একটি মুভি দেখেছিলাম “জুদাই” ( JUDAAI) নামে। শ্রীদেবীর বর অনিল কাপুর। কম বেতনের চাকরি করেও দুই বাচ্চাসহ শ্রীদেবীকে নিয়ে প্রেমে ভরপুর সুখের সংসার। বড়লোক বান্ধবীর সাথে বহুদিন পর রাস্তায় শ্রীদেবীর দেখা হলে আফসোস হয় তার। বান্ধবী যখন জানতে চায় বর কী করেন, শ্রীদেবী বড় বড় গল্প দেয়, বর বড় ব্যবসায়ী, নিজেদের দামি বাংলো, দামি গাড়ি আছে। বান্ধবী জানতে চায়, গাড়ি থাকতে হেঁটে যাচ্ছে কেন! শ্রীদেবী বলে ডাক্তারের নির্দেশে। বান্ধবী নাছোড়বান্দা শ্রীদেবীকে তার গাড়ি করে ঘরে নামিয়ে দেবে। শ্রীদেবী একটি বাংলোর সামনে এসে বলে এটাই তার বাসা। চাবি নেই, গেইটে তালা দিয়ে ওয়াচম্যান কোথায় যেন গেছে। বান্ধবী তখন বলে, চাবি আমার কাছে, কারণ এটি আমার বাংলো। শ্রীদেবী মিথ্যা বড়লোকি গল্প দিয়ে ধরা পড়ে যায়। এক সময় উর্মিলার পছন্দ হয়ে যায় অনিল কাপুরকে, সে বিবাহিত দুই বাচ্চার বাপ জেনেও। অনিল কাপুর কিছুতেই রাজি না উর্মিলাকে বিয়ে করতে। তখন শ্রীদেবীর লোভকে কাজে লাগিয়ে উর্মিলা বলে, অনিল কাপুরকে তাকে বিয়ে করতে রাজি করাতে পারলে দুই কোটি টাকা শ্রীদেবীকে সে দেবে। শ্রীদেবী বরকে চাপ দিয়ে বিয়ে করিয়ে ফেলে উর্মিলার সাথে। দুই কোটি টাকার সুখে বিভোর হয়ে এক সময় খেয়াল হয়, বর বাচ্চারা সবাই তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

মুভির কিছু অংশ তুলে ধরার কারণ আমাদের বাস্তব জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। সব একসাথে এক জীবনে কেউই পায় না। মানুষের যা নেই তার খবরও আমরা পাই না। এজন্যেই যা আছে, তা আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখায়। “শাক দিয়ে মাছ ঢাকা”র মতো। আপনি যদি সত্যিই নিজের স্বামী, সংসার নিয়ে ভালো না থাকেন, তো ভালো থাকার উপায় নিয়ে ভাবুন। উপায় না থাকলে বুঝে শুনে নিজের বুদ্ধিতে সিদ্ধান্ত নিন। অমুকের মতো আপনার সংসার না বলে যদি মনে করেন আপনি ভালো নেই, তো আপনার ভালো দুনিয়ার কারো পক্ষেই করা সম্ভব না।

অন্যের বর এই রকম, অন্যের বাচ্চারা পড়ায় ভালো, অন্যে পরিবার থেকে সাপোর্ট পায়, কিছুই আপনার অনুকূলে নেই, বলে বলে যদি আফসোস করেন; সময়ের সাথে সাথে আফসোস বাড়তেই থাকবে। এই সমাজে লোক দেখানো কিছু সুখী মানুষ আছে, যারা সব সময় প্রতিযোগিতা মূলক কথাবার্তা বলে। আপনার গাড়ি / বাড়ি নাই দেখলে, তার তালতো ভাইয়ের খালতো ভাইয়ের মামাতো ভাইয়ের গাড়ি, বাড়ির গল্প দেবে। আপনার বাচ্চা কোন স্কুলে যায়, পড়ায় কেমন, জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে তার নিজের বাচ্চার পড়াশোনার প্রশংসার পাশাপাশি, তালতো ভাইয়ের খালতো ভাইয়ের বাচ্চার এ-প্লাস পাওয়ার গল্প দেবে, যা শুনে আপনার রাগ হবে নিজের বাচ্চার প্রতি৷ আপনি ভুলেই যাবেন নিজের অবস্থান।

এই সমাজের কিছু মানুষ অন্যদের কাছে নিজেকে সেরা তুলে ধরতে গিয়ে যেই পরিশ্রমটা করে, সেই পরিশ্রম কাজেকর্মে দিলে সত্যিই তারা সেরা হয়ে উঠতে পারতো। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বা হাটে-বাজারে মানুষকে বলে, দেখিয়ে সেরা হওয়া লাগত না। বিশ্বাস করুন এরা আসলে আর কোথাও পাত্তা পায় না। বড় জায়গায় নিজেকে দেখাতে হলে বড় হয়ে যোগ্য হয়েই যেতে হয়, দেখাবার দরকার পড়ে না, মানুষ দেখেই বুঝে। এরা সব সময় ছোট জায়গায় প্রতিযোগিতা করে নিজেদের বড় দেখাতে চায়। আপনি বা আপনারা এদের গুরুত্ব দেন বলেই এরা সাহস পায়। এইসব বিষাক্ত মানুষদের সরাসরি এড়িয়ে চলুন। এরা আপনাদের কাছে সম্পর্কের উন্নতি করতে আসে না। এরা আসে নিজেদের উন্নত জীবন ও খোশগল্পের কাহিনী শুনিয়ে আপনাদের আফসোসের সাথে হতাশা বাড়িয়ে দিতে।

যা আছে, তা নিয়েই বিশ্বাস করুন আপনি ভালো আছেন। যদি কিছুর প্রয়োজন থেকে অভাব বোধ করেন তো, পরিশ্রম করে তা অর্জন করুন। অন্যদেরটা দেখে নিজেদেরকে অভাবী ভাবতে যাবেন না। কারণ সব সময় কারো না কারো আপনার থেকে বেশি থাকবেই। কতবার, কত জায়গায় প্রতিযোগিতায় নামবেন।

আজই ভাবুন। কারণ ভালো থাকার মতো অবস্থানে নেই বহু মানুষ, কোন কিছুই অনুকূলে নেই অনেকের। তারপরও নিজের জন্যে তারা ভালো থাকার চেষ্টা করে চলেছে প্রতিদিন। তাদের থেকে আপনার অনেক বেশি আছে। নিজের যা আছে তা নিয়েই ভালো থাকার চেষ্টা করুন।

শেয়ার করুন: