আমার সংসার, আমার বোঝাপড়া

ফাহমিদা জেবীন:

যখনই কোনো কিছু আমায় ভাবিয়ে তুলে তখনই আশ্রয় খুঁজি কীবোর্ডে। কারণ এর থেকে ভালো ওয়ে আমার জানা নেই। এটা এক ধরনের নেশাও বলা যায়। যাই হোক, যে বিষয়টি নিয়ে আজকের ভাবনার অবতারণা তা হলো অনেকদিন থেকে খেয়াল করছি আজকাল ছেলেরা বিয়ে ভেঙ্গে যাবে এই ভয়ে চট করে বিয়ে করতে চায় না। মানছি এটার জন্য আমরা মেয়েদের স্বাধীনচেতা মনোভাব অনেকেরই অপছন্দ। আমার ছেলের বাবাও সেই দলেই একজন ছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর তাকে অসংখ্যবার বলতে শুনেছি, আমি কেন আরও দশ বছর আগে ওর জীবনে এলাম না।

যাই হোক, গতকাল এক দেবরের সাথে কথা প্রসঙ্গে তার মাঝেও এই ভীতির কথা জানতে পারলাম। আসলে তাকে দেবর না বলি, ভাই বলি। কারণ কিছু কিছু সম্পর্ক রক্তের সম্পর্ককে ছাপিয়ে যায়। আত্মার আত্মীয় হয়ে যায়। এভাবে বলছি কারণ আমি যেদিন থেকে আমার একটি কিডনি আমার স্বামীকে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তখন থেকে যাদেরকে পাশে পেয়েছি তার মাঝে আর্কিব অন‍্যতম। আর জীবনের দুঃসময়ে পাশে থাকা মানুষগুলোকেই আত্মার আত্মীয় বলতেন আমার আব্বা।
এই আর্কিবকে যখনই বিয়ের কথা বলি তখনই সে এর-ওর সংসারের উদাহরণ টেনে ওর ভীতি প্রকাশ করে। অন‍্যের কথা জানি না, আজ এই আর্কিবদের জন‍্যে আমি আমার কথাই বলি।

এতো বছরে যতদূর জেনেছি, অদ্ভুত এক জায়গা সংসার। এক কাদামাটির দলাকে কিছুটা ভালবাসার স্পর্শে, কখনওবা অনেকটা শক্ত বাঁধনে, কখনও একটু জলে ভাসিয়ে, আর কখনও জ্বলন্ত কাঠে পুড়িয়ে এক অন্য মানুষ বানিয়ে ছাড়ে। যে কিশোরী একসময় দুটো বেণী দুলিয়ে সাদামাটা স্বপ্নে বিভোর থাকতো, বাস্তবতা তার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে ধরিয়ে দেয় দায়িত্বের কোল। যে একসময় মা-বাবার আহ্লাদে নাক উঁচিয়ে গাল ফুলাতো, কর্তব্য তাকে নামিয়ে নিয়ে আসে অন্যের মান রক্ষার এক চির অভিযানে। এখানে কেউ নেই চোখ ভিজলে মুছিয়ে দেয়ার, আছে কেবলই চোখ রাঙানোর মানুষ। এখানে আবদার থাকে না, থাকে আবদার রক্ষার গুরুদায়িত্ব। কেউ এখানে ভালোবেসে প্রশংসায় ভাসায় না। বরং আছে পান থেকে চুন খসলে অভিযোগের ভেলায় ডুবে থাকার আশংকা। সারাক্ষণ সবকিছু আগলে এই এতোটুকু চোখ বুজলেই গড়ে উঠে গঞ্জনার পাহাড়।

দাম্পত্য নাকি এক শিল্প! কে জানে, শিল্পকলার পথ তো তেমন একটা মাড়াইনি। খুব মনে আছে, একদিন বড় চাচী দোয়া করে অনেক কিছু বলেছিলেন। তার মধ্যে দুটো শব্দে কিছুটা থমকে গেছিলাম। বলেছিলেন, সংসার হচ্ছে কেবল স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজ!! যত মানতে শিখবে তত সুন্দর সংসার। বেশ মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। জীবনে প্রতি পরতে মা-চাচীরা শুধু আমাকেই মানিয়ে নিতে বলেছিলো, যেন মানাতে হয় কেবল নারীকেই! পুরুষের কোন দায়িত্ব এখানে নেই।

এরপরও আজ এই সংসারে দাঁড়িয়ে কখনই বলতে পারবো না যে একাই সব করেছি, করছি, করতে পেরেছি। কারণ অনৈতিক বা অযৌক্তিক কোনকিছুতে ছাড় না দেওয়া আমি অত্যন্ত জেদি আর যুক্তিতে চোখবাঁধা হবার পরও আমার পাশের লোকটা সদা সর্বদা আমার পানে নিবেদিত। হয়তো সে কারণেই দুজনের চলতে চলতে পথটা আর একঘেয়ে মনে হয় না। তাছাড়া সংসারকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে সেও আজকাল বুঝে গেছে যে, নারীর অভিমান বুঝলে ভালোবাসা বাড়ে, না বুঝলে দূরত্ব!

তবে হ্যাঁ, পথ চলতে ক্লান্ত, বিরক্ত, রাগ, একঘেয়েমি, ঝিমুনি সব এসেছে, তবু সে পথটা আমাদের, তাই ভেবেই এগিয়েছি। অনেকেই প্রশ্ন করেন তাচ্ছিল্য বা খামখেয়ালে, এতো মধুর এই অসম সম্পর্কের মূলমন্ত্র কী? আমি এ কথায় সত্যি হাসি। তবু যা বলি তা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে কতটা প্রেম বা ভালবাসা আছে কী নাই, তা আসলে কখনও বুঝতে যাইনি। সবসময় যা বুঝেছি, আমরা একে অপরকে সম্মান আর বিশ্বাস করি। আমাদেরও সম্পর্কে অনেক উপর-নিচ হয়, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। অনেক কিছু ভেঙ্গেছে -গড়েছে এবং ভাঙ্গবে-গড়বে। তবু কোথাও আমাদের কিছু ছিলো, এই কিছুকে শিল্পে ফেলা যায় কিনা তাও জানি না। তবে দায়িত্ব আর কর্তব্য দুজন দুজনার জন্য করেছি। কাজেই আমি তাকে এবং সে আমাকে আগলে একসূতোয় বেঁধে রাখার চেষ্টা করি। কারও মন পাওয়া মোটেও সহজ না, তবু এই যে চেষ্টা, এটাই হয়তো মানুষকে বেঁধে রাখে।

অনেকে অনেক বছর ধরে প্রেম করে, কিন্তু বিয়ে করার পর দেখা যায় সম্পর্কটা ঠিকঠাক চলছে না। এটা শুধু প্রেমের বিয়েতেই না, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা আরও বেশি দেখা যায়। ঘটনা অনেক কিছুই হতে পারে। আজকাল সবকিছু আধুনিক হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, আমরা সামাজিক বন্ধনের সংজ্ঞা ভুলতে বসেছি। তবে এ সাথে এটাও সত্যি, ভালোমন্দ মিলিয়েই সংসার, তবু কিছু ব‍্যতিক্রম বাদে মন্দটা সব নারীর কাঁধেই আসে। প্রকৃত ঘটনা ঘাঁটতে গেলে অপরপক্ষেরও কিন্তু দোষ কম থাকে না। বরং বেশিই কোন কোন ক্ষেত্রে।

আমি বিশ্বাস করি মেয়েদের জন্য স্পেস প্রয়োজন। তার নিজের একটা জায়গা। এটা দিতে পারলে মেয়েরা কখনোই তার মন ও মস্তিষ্ক থেকে আপনাকে বাদ দিতে পারবে না। পুরো সংসারের কাজ করার পরেও বলবে না ‘আমার কষ্ট হচ্ছে’। যদি আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবেসে তাঁর কাজে একটু হাত বাড়ান এবং বলেন সারাদিন অনেক করেছো, ‘এখন বসো, একটু বিশ্রাম নাও’। কারণ গুণীজনেরা এটাই বলেন যে, ভালোবাসা কোনো দামী জিনিসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে না। মাঝে-মধ্যে ১৫ টাকা দামের গোলাপ আর রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া ৩০ টাকা দামের কাঁচের চুড়ির মধ্যেও ভালবাসা থাকে। শুধু জানতে হয় বিষয়টা। মেনে এবং মানিয়ে নিলেই সংসার স্বর্গ আর না হলেই যুদ্ধক্ষেত্র। তাই একে অন্যকে উত্তম ভালবাসা দেয়াটাই মুখ‍্য। আর একথাটা নারী ও পুরুষ দুজনের জন্যই প্রযোজ্য।

যতদূর চোখ রেখেছি দেখেছি এই সংসার বড় অদ্ভুত রসায়ন। জীবন কেটে যায় পরের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে। কঠিন হলেও সত্যি, নিজের বলে আসলে নিজের আর কিছুই থাকে না এখানে। বিয়ের পর নিজের আপন বাবা-মা, ভাই-বোনও না।

এবার আসি মূল কথায়, খোলা চোখে সংসার দেখতে গেলে গোলক ধাঁধায় বাঁধা পড়তে হয়। বড্ড বিশ্রী আর একঘেঁয়ে হয়ে যাবে তখন জীবন।
আমি তাই সংসার দেখি আমার মনের মতো রঙ মিশিয়ে। এখানে সব আমার, সব। এভাবে দেখি যখন তখনই হঠাৎ ঘন মেঘ কাটিয়ে রোদেলা ঝলমলে সকাল এসে যায়। বিস্তর মন খারাপ বিস্তার নেয় ভীষণ ভালোলাগায়। কারণ আমি কখনই আমার জীবন এবং সংসারকে ঘিরে তৃতীয় কোনো পক্ষের মুখের ঝাল কিংবা মিষ্টি কোনোটার স্বাদ নিতে মোটেও স্বস্তিবোধ করি না। জীবন আমার, তাই কীভাবে দেখবো সেটাও একান্তই আমার….।

লেখক: ফাহমিদা জেবীন

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.