তিনি কি তবে বেহেশতে?

ড. সাবরিনা স সেঁজুতি:

জ্ঞান হারিয়েছিলাম নাকি ঘুম থেকে উঠলাম বুঝতে পারছি না। হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলার বেহেশতে। যেদিকে তাকাই বেহেশতের আমেজ। চারপাশে বেহেশতের গন্ধ। ডাইনে বেহেশত – বায়ে বেহেশত- রন্ধ্রে রন্ধ্রে বেহেশত! তবে একটু অস্বস্ত্বি হচ্ছে, মানে একটু গরম লাগছে, তেষ্টা পেয়েছে । বেহেশত কি ‘বাই ডিফল্ট’ গরম?

বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ পড়লো সিলিং ফ্যানটার দিকে, আরে সেটা তো ঘুরছে না। বুঝলাম সেকারণেই একটু গরম লাগছে। বোধকরি বেহেশতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অন্য কোন উপায় আছে। বিছানা ছেড়ে গেলাম চোখে মুখে পানি দিতে। বেহেশতের আমেজ এখনও বেশ স্পষ্ট। বেসিনের কলটা ঘুরাতেই কল থেকে ভোঁ ভোঁ শব্দ বের হলো, পানি বের হলো না। তবে কি বেহেশতে পানিও লাগে না? লাগে না হয়তো! পানি দিয়ে কী হবে? মনে মনে যা চাইবো তাই তো পাবো, বাহ্যিক জিনিসের কিইবা দরকার!

যাই একটু বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসি। নিজের ঘরের সাথে টাইলস বসানো যে বারান্দা সেখানে গিয়ে একটা মার্লবোরো সিগারেট ধরাবো বলে পকেটে হাত দিলাম। নাকে এলো এক উৎকট গন্ধ। ইশ! বাইরে কোন ইঁদুর টিদুর মরে পড়ে আছে কিনা কে জানে! বেহেশতে কি এসবও থাকে? কী অদ্ভুত! এদিকে পকেট খালি, সিগারেটের প্যাকেটটা নাই। হঠাৎ কে যেন বিকট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো। কাছেই কেউ মাইক লগিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আজকাল চারপাশে এতো মাইকের শব্দ, কে যে কী বলছে কিছুই বোঝা যায় না। তাই কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলাম।

আরে, এই তো শুনতে পাচ্ছি, “মুসলমান ভাইবোনেরা, আপনারা একদম দুঃশ্চিন্তা করবেন না, ঘরে বিদ্যুৎ থাকুক বা না থাকুক, পানি আসুক বা না আসুক, বাজারে যেয়ে সোনার দামে খাবার কেনেন আর নাইবা কেনেন, কিচ্ছু যায় আসে না। মনে রাখবেন আপনারা এখন বেহেশতে আছেন…… ঘড় ঘড় ঘড় (টেকনিক্যাল সমস্যা)……বেহেশতে আছেন!”

আমিও তো সেটাই বলি। এমনিতেই কি আমার সেই কখন থেকে মনে হচ্ছে যে বেহেশতে আছি, বেহেশতের আমেজ পাচ্ছি, বেহেশতের গন্ধ পাছি! এবার তো হাতে নাতে প্রমাণ হয়ে গেলো। ঐ তোরা কে কোথায় আছিস?…… কোন জবাব নাই কারও। মনে মনে ভাবলাম, বাড়ির লোকজন গেলো কই সবাই? নিজের ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমের দিকে গেলাম। উহু, সেখানে কেউ নেই। পাশের রুমেও কাউকে দেখছি না। রান্নাঘরও দেখা যাচ্ছে খালি। ঘরভর্তি ময়লা। পা দেওয়া যাচ্ছে না। কাজের সহকারি মেয়েটা গেলো কই? বাইরে নাকি?

ধুর শালা, বেহেশতে আছি মনেই হচ্ছে না। মাথায়ও থাকছে না যে বেহেশতে কাজের লোক থাকে না, থাকে হুর। ঘরেই বা লোক আসবে কোথা থেকে! ঘরের সব লোক কি আর আমার মতো বেহেশতে আসতে পেরেছে? নিশ্চয়ই না। বেহেশতে রাস্তা ক্লিয়ার রাখার জন্য আমি যতোবার হজ্ব করেছি, কয়জনই বা সেটা করে বা করতে পারে! বউকেও দুইবার হজ্ব করিয়েছি। হজ্ব করাটা এখন দেশে প্রেস্টিজ ইস্যু, না করলে জাত থাকে না। আমি নিজে চুরি-বাটপারি যাই করি না কেন, হজ্বটা ভালোভাবেই করেছিলাম। আর তাইতো আজকে আমি বেহেশতে! সামাজিক মাধ্যমে একটা স্ট্যাটাস দিতে পারলে ভালো হতো। ফোনটা কই? বিছানায় মনে হয়। দৌড়ে গেলাম ঘরে ফোন খুঁজতে।

বিছানায় হাতা পাতা করে কোথাও ফোনটা পেলাম না। শালা, কাজের সময় হাতের কাছে কিছুই পাওয়া যায় না। হঠাৎ মনে হলো আরে, বাসায় তো একটা টিএন্ডটি ফোন ছিল। দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলাম সেই ফোনটার কাছে। এই ফোনের এখন তেমন ব্যবহার নাই। ড্রয়িং রুমে শোভা বাড়ানো ছাড়া এর কোন কাজ নাই। রিসিভারটা কানে তুলে দেখি কোন ডায়াল টোনও নাই। নাহ, বেহেশতের নিয়ম কানুন ঠিক সুবিধার লাগছে না। শালারা ঠকাইলো নাকি আমারে? মনের মধ্যে খচ-খচানি শুরু হলো, সত্যিই বেহেশতে চলে এসেছি, নাকি যেই ভাগাড়ে ছিলাম সেই ভাগাড়েই আছি, বুঝতে পারছি না।

টেলিফোনের পাশে, টিভির রিমোটটা পড়ে ছিল, ভাবলাম টিভি দেখি, মাথাটা ঠান্ডা করা দরকার। রিমোটে চাপ দিলাম, টিভি চলে না। কীরে, চলে না কেন? রিমোটটা এক হাতে নিয়ে আরেক হাতের তালুর মধ্যে দুইটা বাড়ি দিলাম। তবুও কাজ হলো না। এবার সত্যিই মাথাটা গরম হচ্ছে। তেষ্টাও পেয়েছে সেইরকম- পা বাড়ালাম ফ্রিজের দিকে। ফ্রিজ খুলে দেখি, ফ্রিজ খালি। খালি মানে পুরাই খালি- একটা দানাও নাই। কিচ্ছু নাই ক্যান? ঐদিকে মাইকে কে যেন এখনও শুয়োররে মতো চিল্লাইতাছে…। “ভাই ও বোনেরা……আপনারা বেহেশতে আছেন……”!

লেখক: ড. সাবরিনা স সেঁজুতি
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.