ফারদিন ফেরদৌস:
সাউথ এশিয়ান ফুটবল জয়ী মায়েরা এভারেস্টের চূড়া ছুঁয়ে এলেন আমরা তাদেরকে সোৎসাহে বরণ করলাম। এখন অন্য আলাপ আসলে খাটে না।
তবু ২০১৮ সালে আঁকা একটি কার্টুনের কাটাছেঁড়া, এক পপুলার মৌলভি কর্তৃক ফুটবলারদের গরীব বলে কটাক্ষ করবার ভয়ানক রেসিজম এবং এক মায়ের ওই মৌলভিদের দেখানো লোভাতুর বেহেশত বর্জনের দুঃসাহস নিয়ে দু চার কথা বলাই যায়।
২০১৮ সালে শিল্পী কিশোর একটি কার্টুন এঁকেছেন। যেখানে স্পষ্ট বোঝা যায়, যে মানুষটি চরমভাবে নারী প্রগতি বিরোধী, নারীকে ব্যভিচারের কারখানা বলে ঢালাও মন্তব্য করেছিলেন। নারীদেরকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে ‘লালাতত্ত্ব’ হাজির করেছিলেন। ১৩ দফার মতো পশ্চাৎপদ মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। যেই মানুষটির অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীদের ফুটবল বন্ধ করবার জন্য মিছিল মিটিং করেছে। মাঠ বরাবর মার্চ করবার ঘোষণাও দিয়ে রেখেছিল। তেমন মানুষদেরকে ক্যারেক্টার বানিয়ে কেরিক্যাচারটি করা হয়েছিল। এখনো যারা তেমন উগ্র মতাদর্শকে মনেপ্রাণে লালন করেন তাদের উদ্দেশ্যে কার্টুনটি আরেকবার প্রচার হয়েছে। এখানে আমাদের পরহেজগার বাবা দাদাদের উদ্দীষ্ট করে কার্টুনটি যে আঁকা হয়নি তা সবাই বুঝেও না বুঝবার ভাণ করছে।
মোদ্দাকথা হলো আমাদের মেয়েদের যে বিশাল অর্জন তার তুল্যমূল্যে কার্টুনের ওই স্বাধীনতাটুকু তেমন কিছুই না। যারা নারীদের ফুটবলকে বাধাগ্রস্থ করতে চেয়েছিলেন তারা ইতোমধ্যে বড় মেসেজ পেয়েই গেছেন।
সর্বোপরি যার কথা এতক্ষণ আলাপ করা হলো আধুনিক সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী ওই মানুষটির কাছ থেকে খোদ দেশের প্রধান নির্বাহীকে ‘জননী’ বলে স্বীকৃতি নিতে হয়েছে। এমন বড় ঘটনার পর কার্টুনটির এতটুকু মূল্য আমার কাছে নেই। যেখানে যেচে গিয়ে সাত সমুদ্দুর দিয়ে এসেছি, সেখানে এক বিন্দু বারির আক্ষেপ নিয়ে আলাপ বাতুলতা মাত্র।
তারপরও এই কার্টুনটি যারা এখনও ছেপে চলেছেন তাদের পক্ষে কি একরত্তি যুক্তিও নেই?
আমাদের কন্যারা শিরোপা জেতার পর প্রমিনেন্ট এক মৌলভি এই বিজয়কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘এসব মেয়েরা নিতান্ত গরীব ঘরের সন্তান। যদি তারা একটু সচ্ছল ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতেন তাহলে তাদের কয়জন ফুটবলকে পেশা হিসেবে বেছে নিতেন সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। সুতরাং ‘নারীবাদ’-এর মতো বড়লোকি তত্ত্ব তাদের জীবনে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বহীন।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘এটা সত্য যে, যেটাকে খেলা বলা হচ্ছে সেটা মূলত: একটা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সেই আগ্রাসনে যাদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক সময় তারা নিজেরাও জানেন না যে কিছু পয়সার বিনিময়ে তাদের কোন কাজে ইউজ করা হচ্ছে।’ শেষে তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সকল নারী ফুটবলারদের প্রতি দা’ওয়াতী কার্যক্রম চালানোর খায়েশ প্রকাশ করেছেন, যাতে তাঁরা মানুষের হেদায়েতের কারণ হতে পারে।
একবার ভাবেন তো উনি কি এইভাবে বলতে পারেন যে, রূপনা চাকমা কিংবা কৃষ্ণা সরকারদের প্রতি দাওয়াতী কার্যক্রম চালাতে হবে! উনি সব খেলোয়াড়কে নিতান্ত গরীব ঘরের সন্তান বলে মারাত্মক বর্ণবাদী মন্তব্য করতে পারেন? এটা সুস্পষ্ট সংবিধান বিরোধিতা। মানবিক বোধ ও বিবেকের বিরোধিতা।
বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে পূর্ণ আস্থাবান তিনি ফুটবল খেলাকে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলছেন। তাহলে এই যে ফেসবুকে তিনি এসব কথা বললেন, ফেসবুক তো সবচেয়ে বড় পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সেটাকে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখছেন কেন? সব দোষ ফুটবলের? ইউটিউব, গুগল, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন আর চিল্লানোর মাইক খুব আরাম, তাই না?
ইতোমধ্যে ফেসবুকে ঘুরতে থাকা এক ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে, এক নারী ফুটবলারের অভিভাবক সাংবাদিকদের বলছেন, ‘আমার ছইলদের (মেয়েদের) খেলাত দিছি দেখি আমার গুষ্টিটা শুদ্ধাই বলে দোজখত যাইবে। এগুলাও মানুষ কয়, এগুলাও মানুষ কইছে। আমরা বেহেশতে যাবার নাই, দোজখেই যাব।’
শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা দেয়া নারীটির বক্তব্য স্রেফ ওপরে আলাপ করা ওই মৌলভি ও তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। যারা পশ্চিমাদের ফেসবুক ইউটিউব থেকে অর্থ কামাই করে সেই টাকায় রোজ বেহেশত সেল করে। ফুটবলার কিংবা তাদের আত্মপ্রত্যয়ী অভিভাবক গ্রাম্যবালারা তাদের কথিত বেহেশত ক্রয় করবার জন্য বসে থাকেনি। থাকবেও না। তারা তাদের আত্মধর্মেই বলিয়ান।
ঘটনা যে মৌলভি ও তাদের ভাবশিষ্যদের খায়েশ মতো হচ্ছে না, সেটা দিব্য চোখেই দেখা যাচ্ছে।
ফুটবলার মেয়েরা ও তাদের পরিবারের স্বজনেরা এখন সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। যাদের কথা বলা হচ্ছে জনমানসে, চায়ের আলাপে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, টেলিভিশনে ও পত্রপত্রিকায়।
রাষ্ট্র তাদেরকে মাথায় করে রাখছে। বীরোচিত সংবর্ধনা দিচ্ছে।
কড়া রোদেও যাদের বরণ করতে ফুল হাতে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়েছে প্রগতিবাদী হাজারও মানুষ।
নারীরা ফুটবল নিয়ে কোনো রাজনীতিতে নামেননি। তাই রাজনৈতিক ধর্মাচারীদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো সংক্ষুব্ধতাও নেই। কিন্তু যে গোষ্ঠিটি নারীর স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে, তাদের অধিকার হরণ করতে চাইছে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও টিপ্পনী করে যাচ্ছে সেই গোষ্ঠিটির বিরুদ্ধে যদি সামান্য একটা কার্টুনের প্রতিবাদ আঁকেন কোনো শিল্পী তাকে নিন্দা করবেন কোন মুখে।
দেশটারে একটা শ্রেণী কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে তা বুঝেও না বুঝবার ভাণ করাটা মানবমুক্তির জন্যই অন্তরায়। আমরা সেই অন্তরায়ের অন্তরালে থাকবো আর কতকাল?
সভ্যতাকে গতি দিতে চাইলে নারীকে ঘরের বাইরে এনে প্রগতির মাঠের সবুজ ঘাস ছুঁতে দিতে হবেই।
লেখক: সাংবাদিক
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২