ইমতিয়াজ মাহমুদ:
ফাইনাল খেলার আগের দিন সানজিদা আখতারের ফেসবুক পোস্টটা সকলকে স্পর্শ করেছে। ফেসবুকে আর ইন্সটাগ্রামে প্রায় সকলেই সানজিদার কথার কোন না কোন অংশ হুবহু বা একটু রূপান্তর করে শেয়ার করেছে। এক সংবাদকর্মী বন্ধু জানলেন যে সানজিদার ঐ পোস্টের পর এমন একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েদের ফাইনাল খেলা নিয়ে যে টেলিভিশন চ্যানেল টি-স্পোর্টস উদ্যোগ নিয়ে খেলাটি সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিল। আর খেলাটি যখন সম্প্রচার শুরু হয় তখন টি স্পোর্টসের টেলিভিশন চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানলে আর ফেসবুক সম্প্রচার দেখেছে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। ফাইনাল শেষ হওয়ার পরেও একাত্তর টেলিভিশনসহ প্রায় সকল টেলিভিশনের আলোচনাগুলিতে ঘুরে ফিরে সানজিদার ফেসবুক পোস্টের কথাগুলি এসেছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এমপি কর্মকর্তাদেরকেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেখেছি সানজিদার কথা আলোচনা করছেন, সানজিদার প্রশংসা করছেন এবং সাধারণভাবে আমাদের মেয়েদের জীবন সংগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছেন। এইগুলি তো ভালো কথা আরকি- একজন লড়াকু খেলোয়াড়ের এইরকম মর্মস্পর্শী বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ সব লোকে আলোচনা করছেন, ভালো কথা না? খুবই ভালো কথা।
কিন্তু একটা শঙ্কা আমার মনে থেকেই যাচ্ছে, আপনারা আবার সানজিদার পোস্টের ছাদখোলা বাসের কথা আক্ষরিকভাবে নিয়ে ওর আসল কথাগুলি ভুলে যাবেন না তো? আমাদের সরকারের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে সরকার মেয়েদের জন্যে ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করছে। ছাদখোলা বাস ঢাকায় না থাকায় বিআরটিসির একটা বাসকে রূপান্তর করার কাজ চলছে, কাল সকাল নাগাদ রেডি হয়ে যাবে।
এটাও ভালো কথা। বিশাল একটা ছাদখোলা বাসে সড়ক থেকে অনেকটা উঁচুতে আমাদের বিজয়ী কন্যারা ট্রফি উঁচিয়ে নগরের রাজপথ ধরে যাবে, আমরা চারদিক থেকে ওদেরকে অভিনন্দন জানাবো, ওদের বিজয়ে আমাদের উল্লাস প্রকাশ করবো, কাঁদবো, হাসবো চিৎকার করবো আর ওদের দিকে ফুল ছুঁড়ে দিব- আমরা সকলে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করবো আর আমাদের মেয়েরা বিজয়ীর বেশে রাজধানীতে প্রবেশ করবে। এরকম একটা দৃশ্য কল্পনা করতেই তো বেশ লাগে, আবেগে আক্রান্ত হয়ে যাই। কিন্তু আবারও সেই শঙ্কাটা জাগে, সানজিদা ও তার সহযোদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষার এইরকম আক্ষরিক অর্থ করে আমরা না আবার মূল প্রসঙ্গটা হারিয়ে ফেলি।
মূল কথাটা কী? এই ছাদখোলা বাসের প্রকৃত ব্যাপারটা কী? একটা ডাবল ডেকার বাসের ছাদবিহীন দোতলায় কয়েকটা আসন- এই-ই কি একটা ছাদখোলা বাস? এইটাই আমাদের মেয়েদের আকাঙ্ক্ষা? সানজিদা কি কেবল এইটা কামনা করেই লড়াই করার দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়েছে আপানদেরকে? এর জন্যেই কেবল ওরা বলেছে যে হারজিৎ জানি না, জীবনযুদ্ধে লড়াই আমরা জানি, আমরা লড়ে যাবো শেষ পর্যন্ত?
না, জনাব।
সবিনয়ে বলি, আমাদের মেয়েরা ছাদখোলা একটা বাসে নগর পরিভ্রমণের মধ্যেই ওদের আকাঙ্ক্ষা সীমিত রাখেনি। ছাদখোলা বাস সে তো একটা প্রতীক মাত্র। আমাদের মেয়েরা ওদের জন্যে এবং ওদের পরবর্তী প্রজন্মের যেসকল মেয়েরা ফুটবল খেলতে আসবে সকলের জন্যে খোলা আকাশ চেয়েছে, মুক্ত বাতাস চেয়েছে, মুক্ত স্বাধীন জীবন চেয়েছে। আজকের মেয়েরা চেয়েছে আগামীর সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া আর ঋতুপর্নাদের জন্যে যেন সংগ্রামের পথটা আরেকটু সহজ হয়। যে টিপ্পনী ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সানজিদা ও ওর সহযোদ্ধাদেরকে মোকাবেলা করতে হয়েছে আগামী দিনের মারিয়া, সাবিনা, কৃষ্ণা আর শামসুন্নাহারদের যেন সেই একইরকম টিপ্পনী আর প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে না হয়।
আমাদের এই ফুটবল দলের মেয়েদের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করবেন। ওরা আপনাদের কাছে খুব বেশি কিছু কখনও চায়নি, এখনও চায় না। বেশি কিছু চায় না তার দুইটা কারণ আছে। প্রথমত ওরা তীব্র দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে অভ্যস্ত সেই কারণে বৈষয়িক চাহিদার পরিধি ওদের সীমিত। দ্বিতীয় কারণ আমি যেটা দেখি- আমাদের মেয়েরা তো লড়াই করেই নিজের সম্মান অর্জন করতে চায়, কারও কাছ থেকে এমনিতে চেয়ে নেওয়া সেটা ওদের স্বভাবসিদ্ধ হওয়ার কথা নয়।
মনে রাখবেন, যে মেয়েটি বাল্যবিবাহের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে পিতামাতার বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ করেই ফুটবল খেলতে এসেছে ওর কাছে দুইবেলা সুস্বাদু খাবার, কিছু অর্থ ইত্যাদি সেগুলি গুরুত্বপূর্ণ তো বটে, কিন্তু ঐসবই ওর জীবনের লক্ষ্য বা গন্তব্য হতে পারে না। অথবা ধরেন যে মেয়েটা সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছে, ওর পরিবার ওর সমাজ ওর চারপাশের মানুষ ওকে খোঁচা দিয়েছে প্রতিদিন, ওকে নিয়ে কটু কথা, অশ্লীল ইঙ্গিত করেছে যত্রতত্র আর এই সবকিছু উপেক্ষা করে সে অবিচল দৃঢ়তায় লাথি মেরে গেছে ফুটবলে- সে তো সামান্য ব্যক্তিগত কিছু বৈষয়িক প্রাপ্তির জন্যে লড়াইটা করেনি। অথবা ধরেন দরিদ্র চাষার মেয়েটা, যার পিতাকে হাতে মাঠে মসজিদে সমাজে মন্দ কথা শুনতে হয়েছে মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে মাঠে ফুটবলে লাথি মেরে বেড়ায় বলে- ওর মুক্তি কি কেবল কিছু টাকা পয়সাতে আসবে?
আপনারা বিআরটিসির একটা ডাবল ডেকার কেটে ছাদখোলা বাস বানিয়েছেন। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলকে আমার বেশ পছন্দ। তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন। তাকেও ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু এটাতেই আমাদের মেয়েদের প্রকৃত আফসোস প্রকৃত আক্ষেপ আর প্রকৃত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পুরোপুরি হয় না।
আসলেই যদি আমাদের চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চান আর আসলেই যদি আমাদের দেশের সকল কন্যা শিশু আর সকল কিশোরীদের জন্য একটি খোলা আকাশের ব্যবস্থা করতে চান, তাইলে মেয়েদের জন্যে জন্যে যেন আকাশ উম্মুক্ত থাকে, মেয়েদেরকে যেন দৃষ্টি নিচু করে মেরুদণ্ড বাঁকা করে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে না হয়, মেয়েরা যেন ইচ্ছেমতো ছুটতে পারে, ইচ্ছেমতো উড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা করেন।
নিজেদের লড়াইটা যে মেয়েরা নিজেরাই লড়ে নিতে পারে সেকথা তো প্রমাণিত হয়েই গেছে। আপনাদের কাজটা হবে শুধু কেউ যেন আমাদের মেয়েদেরকে মাহফিল থেকে গালি দিতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। যেন কোন মৌলানা আমার মেয়েকে ‘তেঁতুল’ বলে চিহ্নিত করতে না পারে। যেন কোন ধর্মান্ধ তস্কর আমার জিনস, টিশার্ট পরা মেয়েটিকে রাস্তায় বাসে বা রেলওয়ে স্টেশনে বাজে গালি দিয়ে ওকে মারবে বলে ছুটে আসতে না পারে। আপনাদের দায়িত্ব হচ্ছে নিশ্চিত করা যেন কোন বেয়াদব পুরুষ, হোক সে ছাত্র, হুজুর, জজ বা পুলিশ আমাদের মেয়েদেরকে ড্রেসকোড শেখাতে না আসে।
না, আপনারা হয়তো এটা করতে পারবেন না। একটা দোতলা বাসের ছাদ কেটে ফেলে দিয়ে ভাববেন যে না জানি কী বিশাল উপহার দিয়ে দিলাম মেয়েদেরকে। সানজিদার আক্ষেপের একটা লফজ তুলে নিয়ে সেটাকে আক্ষরিক অর্থ করে বাস কেটে ভাবেন যে, না, ওদের আক্ষেপ পূরণ করে দিলাম। চিন্তা করবেন না। মেয়েরা লড়াইটা চালিয়ে যাবে। আমি তো বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখে এসেছি নারীরা লড়ছে। সানজিদারাও তো বলেছে, ওরা জীবন যুদ্ধে অভ্যস্ত- লড়াইটা ওদের জীবন যাপনেরই অংশ- মাঠে এবং মাঠের বাইরে দুই জায়গাতেই। চিন্তা করবেন না, মেয়েরা লড়াইটা চালিয়েই যাবে- এবং আপনারা না চাইলেও মেয়েরা একদিন ঠিকই জিতবে। শুধু এইটা প্রত্যাশা করি, নারীর লড়াইতে আপনারাও যেন পাশে থাকেন।
(ফিচারে ব্যবহৃত বাসের ছবিটি অন্তর্জাল থেকে নেয়া)