টুপিখোলা অভিনন্দন, মেয়েরা

সুপ্রীতি ধর:

সাবাশ মেয়েরা, সাবাশ।

কী বলে তোমাদের অভিনন্দন জানাবো, জানি না। আনন্দে আমার কেবলই কান্না আসছে। তোমরা পেরেছো। সত্যিই পেরেছো অসম্ভবকে সম্ভব করতে। তোমাদের যাত্রাপথটুকু না জানা থাকলে হয়তো এতোটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতাম না। জানি বলেই আজ এই আনন্দ কেমন যেন কষ্ট হয়েই বুকে বাজছে। সেকারণেই আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না।

ল্যাপটপের স্ক্রিনে তোমাদের হাসিমুখগুলো যখন দেখছিলাম একটা নেপালি ইউটিউব চ্যানেলে, আমার তোমাদের ফেলে আসা বন্ধুর পথটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল তোমাদের মধ্যে দুই বোনের সেই কষ্টের দিনগুলির কথা। টিভি নেই বলে তোমাদের বাবা-মা, ভাইবোন কখনও তোমাদের খেলা দেখতে পারতো না, তাছাড়া দেশে তো মেয়েদের খেলা দেখানোতেও অনীহা। মনে পড়ে যাচ্ছে তোমাদের মাঝের সেই মেয়েটির কথা যে কিনা সদ্যপ্রসূতি মা, যে কিনা তার দুই মাসের বাচ্চাকে রেখে এসে মাঠে নেমেছিল কিছু টাকা উপার্জনের জন্য। তবে এতো প্রতিবন্ধকতার মাঝেও এই যে তোমরা আজ এতোবার করে খেলার মাঠে বাংলাদেশ নামটা উচ্চারণ করালে, সেইজন্য আজ কোন নেতিবাচক কথা নয়। কেবল বলবো তোমাদের অসীম সাহস, ধৈর্য, লড়াকু মনোভাবের কথা। এসব মিলিয়ে যে উদাহরণ তোমরা আজ সৃষ্টি করলে তা ইতিহাস হয়ে থাকবে। পিছিয়ে পড়া মেয়েদের জন্য তোমরা অনুকরণীয় হয়ে গেলে। ভবিষ্যতে অনেক সাবিনা, শ্রীমতি, মার্জিয়া, কৃষ্ণা, শারমিনরা আসবে, তাদের জন্য দুর্গম পথটা তোমরাই সুগম করে দিয়ে গেলে। তোমাদের স্যালুট।

(ছবিটা অন্তর্জাল থেকে নেয়া)

যে পশ্চাদপদ, কুপমণ্ডুক, ধর্মান্ধ, জেন্ডার বায়াস্ড জাতি যারা নিজের প্রয়োজনে মেয়েদের আপাদমস্তক মুড়ে দেয়, বস্তাবন্দি করে, শিকলবন্দী করে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সকল নিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আর সেই নীতি-তন্ত্রের পশ্চাদ্ দেশে লাথি দিয়ে গোল করার মতো মানসিক জোর যেই মেয়েদের তাদের জন্য ভালোবাসা আর আশীর্বাদ! সেই সমাজকে তোমরা তুড়ি মেরে দেখিয়ে দিয়েছো মেয়েরা। ভালো প্রশিক্ষণ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা পেলে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীও যে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে বিশ্বের বুকে, তা আজ তোমরা দৃষ্টান্ত গড়ে জানান দিলে। ঠিক এমন আভাসই ছিল আজকের একটি ফেসবুক পোস্টে, যেটি লিখেছেন বাংলাদেশ টিমেরই সানজিদা আখতার। তিনি লিখেছেন, ‘যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থনের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনীকে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছুটা হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।’ এটাই স্পিরিট।

সাফ উইমেনস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২ এ ৩-১ গোলে নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল টিম আজ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। পুরো টুর্নামেন্টেই আমাদের মেয়েদের দাপট ছিল অতুলনীয়, অভাবনীয়। আর তারই ফল হিসেবে সেরা গোলকিপার, সেরা খেলোয়াড়, সেরা গোলদাতা সব পুরস্কার একাই জয় করে নিয়ে এসেছে ওরা। অর্থাৎ

* চ্যাম্পিয়ন

* ফেয়ার প্লে

* গোল্ডেন বুট – সাবিনা

* গোল্ডেন বল – সাবিনা

* গোল্ডেন গ্লাভস – রুপনা

এবারের সাফ ফুটবলের টানা চার ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশের নারীরা। প্রতিপক্ষের জালে ২০ বার বল পাঠানোর বিপরীতে একটি গোলও হজম করেনি তারা। মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ পর্ব শুরু করা নারীরা পরে পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দেয় ৬-০ গোলে।
সাফের গত পাঁচ আসরের সবকটিতে শিরোপা জেতা ভারতকে শেষ ম্যাচে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। আর সেমিফাইনালে সাবিনা খাতুন, ঋতুপর্ণা চাকমা, কৃষ্ণা রানী সরকার, মনিকা চাকমাদের কাছে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয় ভুটান। ৮-০ গোলে জিতে বাংলাদেশ যায় ফাইনালে।

তাই আজকের দিনটি ইতিহাসে লেখা থাকুক, এ ভোলার নয়।

(ফিচারে ব্যবহৃত ছবিটি সম্ভবত সময় টেলিভিশনের। সঠিক জানি না বলে ক্রেডিট দেয়া গেল না।)

শেয়ার করুন: