ফারদিন ফেরদৌস:
বাঙালি বিজ্ঞানবিমুখ হয়ে যাচ্ছে।
দিন দিন হারাচ্ছে বোধ ও বিবেক।
এই সুযোগে একটি শ্রেণী রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে জানান দিচ্ছে নারীর নাম শুনলেই নাকি তারা সিডিউসড তথা প্রলুব্ধ হয়ে যান।
চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় তাপমাত্রার পারদ ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাওয়া বাংলাদেশে জীবন ও জীবিকার তাগিদে কর্মস্থলে যাতায়াতকারী নারীর হাতে ও পায়ে কালো মোজা না পরিয়ে, আপাদমস্তক অবগুণ্ঠনে বস্তাবন্দি না করে ওই পুরুষ শ্রেণিটার যেন একদমই স্বস্তি নেই। ওই পুরুষ শ্রেণীটি এমনকি তাদের অন্ধ অনুসারী নারীরা পর্যন্ত বিজ্ঞানকে কটাক্ষ করতে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছে। নারীরা প্রায় ভুলতেই বসেছে তার স্বাধীনচিন্তার কথা। পুরুষের জবানিতে নিজেদের অবরুদ্ধ থাকবার বিষয়টি ফলাও করে জানাচ্ছে।
ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল, টুইটার, টিকটক, স্পার্টফোন, বিদ্যুত, পেনিসিলিন, ওর স্যালাইনসহ সব সুবিধা আমরা নিয়ে থাকি একজন নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানীর গবেষণালব্ধ আবিষ্কার বা একাগ্র বিজ্ঞানচর্চার কাছ থেকে। তথাপি আমরা সেই বিজ্ঞানকেই কটাক্ষ করবো, এটা তো হতো পারে না।
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অন্তত একজন নেকাবধারী মুখঢাকা বিজ্ঞানী দেখা যাবে না যিনি মানুষ ও পৃথিবীর সভ্যতা বিনির্মাণে সামান্যতম ভূমিকাও রেখেছেন? একজন অবগুণ্ঠিত নারীকে পাওয়া যাবে না, যিনি মানবীয় সভ্যতা বিনির্মাণে কোনো ভূমিকা রেখেছেন। কারণ যিনি মুখ ঢেকে রাখেন তাকে আমরা চিনি না। নিজের পরিচয় গোপন করা কিছুতেই মানবীয় গুণাবলী হতে পারে না।
বিজ্ঞান কখনোই কারো পোশাক নিয়ে পড়ে থাকে না। উচ্চ তাপমাত্রার দেশে স্বাভাবিকতা ও শারীরিক সুস্থতা বিরোধী পায়ে ও হাতে কালো মোজা পরাসহ নাক মুখ মাথা অবগুণ্ঠিত রাখবার পরামর্শও বিজ্ঞান দেয় না।
কাজেই পোশাকের ছোটো বা বড়ত্ব বিজ্ঞান-গবেষণার নির্ণায়ক হতে পারে না। তারপরও যেহেতু পোশাক মানুষের ব্যক্তিগত চয়েস, সেহেতু আজকে না থাকলেও আগামীতে একজন নেকাবধারী কালজয়ী ও বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী হয়ে ওঠবে না -এমনও কথা নেই। কাজেই শারীরিক সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে একজন মানুষ যদি বড় পোশাক পরে সেটা নিয়ে যেমন গসিপ চলতে পারে না, তেমনি একজন শর্ট ড্রেসের নারীকেও শারীরিকভাবে নিগ্রহ করবার চিন্তাকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
ধর্মবোধ মানুষকে বিনয়ী করবে, ঘৃণাবোধ না ছড়িয়ে সবার প্রতি সহনশীল হতে শেখাবে, আচারিক নৈতিকতায় শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলবে -এটাই তো হওয়া উচিত।
কে ছোটো পোশাক পরবে,
কে বড় আলখাল্লা পডরবে এই অনাহুত
ভাবনায় কেন ধর্মকে পড়ে থাকতে হবে?
বাংলাদেশের পড়ালেখায় বিরাট গলদ ও ভারসাম্যহীনতার সুযোগে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে পেরে ওঠছে না। শিক্ষা গবেষকদের মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৯ ভাগ স্টুডেন্টই এখন মাদ্রাসা থেকে আসে। কে না জানে মাদ্রাসায় ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তাহলে সেখান থেকে আসা এমন একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করবে, খোদ নারীই নারীপ্রগতির বিরোধী হবে, ছেলেরা লৈঙ্গিক রাজনীতি দিয়ে মেয়েদের সাথে আচরণ নির্ধারণ করবে -এটা খুব অস্বাভাবিক নয়।
যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারায় নিয়ে আসা উচিত ছিল সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানই আজ প্রায় মাদ্রাসায় পরিণত হয়ে গেছে। একমাত্র ঐশী জ্যোতিই যাদের ভরসা তারা বাস্তবতার নিরিখে এবং গণ মানুষের উপলব্ধি সাপেক্ষে তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ নির্ভর গবেষক হবে, চিন্তায় সাম্যবাদ ও আধুনিক মন মানসিকতা পোষণ করবে -এই আশা করাটাও বিরাট ভুল।
এই বিশ্ববিদ্যালয় তার স্টুডেন্টদের শেখাচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের গায়ে বাংলাদেশের তথাকথিত ছোটো পোশাক দেখলেই ‘সিডিউসড’ হওয়া যায়! বিশ্ববিদ্যালয় শেখাচ্ছে নারীমুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে বাতিল করে দিয়ে সকল নারীকে কালো কাপড়ে মুড়িয়ে অবরোধবাসিনী হয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় নারীরা স্লিভলেস পোশাক পরে ফটোসেশন করলে তাকে পাকড়াও করে হেনস্তা করছে খোদ নারী শিক্ষকরাই!
বোধের কী ভয়ানক অবনমন! এই ছেলেমেয়েরা এবং তথাকথিত এইসব শিক্ষকেরা বিশেষ করে স্বঘোষিত সিডিউসড ছেলেরা যদি পশ্চিমে যায় সেখানকার মেয়েদের দেখে এই অসভ্য ও অভব্য ছেলেদের অবস্থাটা কী হবে? এই ছেলেরা যদি বৃহৎ মুসলিম কান্ট্রি ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে ভ্রমণের সুযোগ পায় সেখানকার মেয়েদের কী গতি করবে?
বিকারগ্রস্ত এইসব ছেলেমেয়েদের প্রপার মানসিক চিকিৎসা দরকার। এদের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা ও মানবিক বোধ ফিরিয়ে আনা জরুরি। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলনলচেই পাল্টে ফেলা দরকার।
দেশের অপরাপর বিদ্যায়তনের মতোই শিক্ষার্থীদের যথার্থ মানবিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও দিক বদলে ফেলেছে।
এই ভয়াল বদলের মুখে এইসব কোমলমতি স্টুডেন্টকে দোষারোপ করবার আগে আমাদেরকে রাজনীতির গোড়ায় হাত দিতে হবে। জানতে হবে কারা মনিটরিং ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা জিইয়ে রেখেছে? বুঝতে হবে দাখিল আলিম পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ ফাইভের কেন এত ছড়াছড়ি? কারা এসএসসি’র সমতুল্য দাওরায়ে হাদিস পাশ মাত্র ১৭ বছর বয়সীদের মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়ে রেখেছে?
বিশ্ব সভ্যতার মানদণ্ডে একদম অগ্রহণযোগ্য ও অদ্ভুতুড়ে প্ল্যাকার্ড হাতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে যেসব কোমলমতি শিক্ষার্থী সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের শুভবোধের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ালো, তাদেরকে সমালোচনা করবার আগে আমরা বড় করে ভাবতে চাই…
স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বর্তমানে সরকার ব্যবস্থা চালায় তো!
ডেমোক্রেসি, সোশ্যালিজম ও সেক্যুলারিজমের ধারক আওয়ামী লীগের কাছেই তো দেশের সকল ক্ষমতা, তাই না!
লেখক: সাংবাদিক