‘বন্ধনেই মুক্তি’

কৃষ্ণা দাশ:

কৃষ্ণা দাশ

সংসার করছি অনেক বছর, অদ্ভুত এক জায়গা সংসার। এক কাদামাটির দলাকে কিছুটা ভালবাসার স্পর্শে, কখনও বা অনেকটা শক্ত বাঁধনে, কখনও একটু জলে ভাসিয়ে, আর কখনও জলন্ত কাঠে পুড়িয়ে এক অন্য মানুষ বানিয়ে ছাড়ে। যে কিশোরী একসময় দু বেণী দুলিয়ে সাদাসিধে স্বপ্নে বিভোর থাকতো, বাস্তবতা তার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে ধরিয়ে দেয় দায়িত্বের কোল। যে একসময় মা বাবার আহ্লাদে নাক উঁচিয়ে গাল ফুলাতো, কর্তব্য তাকে নামিয়ে নিয়ে আসে অন্যের মান রক্ষার এক চির অভিযানে। এখানে কেউ নেই চোখ ভিজলে মুছিয়ে দেয়ার, আছে চোখ রাঙানো। এখানে আবদার থাকে না, থাকে আবদার রক্ষার গুরু দায়িত্ব। কেউ এখানে ভালবেসে প্রশংসায় ভাসায় না, আছে পান থেকে চুন খসলে অভিযোগের ভেলায় ঢুবে থাকার আশংকা। সারাক্ষণ সবাইকে আগলে এই এতোটুকু চোখ বুজলেই বেড়ে উঠে গঞ্জনার পাহাড়।

দাম্পত্য নাকি এক শিল্প! কে জানে, শিল্পকলার পথ তো খুব একটা মাড়াইনি আর এ যে এক বিশাল শিল্প তা মোটামুটি বুঝবার আগেই আমি এই দাম্পত্য নামক বেড়াজালে বন্দী। খুব মনে আছে, আমার মুখ দেখার দিন মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা আর্শিবাদ করে অনেক কিছু বলেছিলেন, তার মধ্যে দুটো শব্দে আমি কিছুটা থমকে গেছিলাম। বলেছিলেন, সংসার হচ্ছে কেবল স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজ!! যত মানতে শিখবে তত সুন্দর সংসার। বেশ মন খারাপ লেগেছিলো সেদিন। সবাই শুধু আমাকেই মানিয়ে নিতে বলেছিলো, যেন মানাতে হয় কেবল নারীকেই! এরপরও বলবো না, একাই সব করেছি, করতে পেরেছি, কারণ আমার পাশের লোকটা ‘সদা সর্বদা আমার পানে নিবেদিত’ হয়তো সে কারণেই দুজনের চলতে চলতে পথটা আর একঘেয়ে মনে হয়নি।

হ্যাঁ পথ চলতে ক্লান্ত, বিরক্ত, রাগ, একঘেয়ামি, ঝিমুনি সব এসেছে, তবু সে পথটা আমাদের, তাই ভেবেই এগিয়েছি। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তাচ্ছিল্য বা খামখেয়ালে, আমাদের সম্পর্কের মূলমন্ত্র কী? আমি একথায় সত্যি হাসি। তবু যা বলি তা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে কতটা প্রেম বা ভালবাসা আছে কি নাই তা আসলে কখনো বুঝতে যাইনি। তবে সব সময় যা বুঝেছি, আমরা একে অপরকে সম্মান আর বিশ্বাস করি। আমাদেরও সম্পর্কে অনেক উপরনিচ হয়েছে, ভেঙ্গেছে -গড়েছে। তবু কোথাও আমাদের কিছু ছিলো, এই কিছুকে শিল্পে ফেলা যায় কিনা তাও জানি না। তবে দায়িত্ব আর কর্তব্য দুজন দুজনার জন্য করেছি। এখানে দুজনারটা একটু পরিষ্কার করা যাক, আমরা শুধুমাত্র ‘আমাদের’ দিয়ে পরিপূর্ণ আর এই ‘আমাদের’ পরিপূরক হয়ে উঠে ‘আমাদের’ দুজনার দুটো পরিবারের সমন্বয়ে। এদের বাদ দিয়ে আমরা আর আমাদের হয়ে উঠতে পারি কোথায়? কাজেই আমরা আমাদের পরিবারকে আগলে একসূতোয় বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছি। সবার মন পাওয়া মোটেও সহজ না তবু এই যে চেষ্টা, এটাই আমাদের বেঁধে রেখেছে।

অনেকে অনেক বছর ধরে প্রেম করে কিন্তু বিয়ে করার পর দেখা যায় সম্পর্কটা ঠিকঠাক চলছে না। এটা শুধু প্রেমের বিয়েতেই না, এ্যারেঞ্জ ম্যারেজের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা আরো বেশি দেখা যায়। ঘটনা অনেক কিছুই হতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এদের মাথায় থাকে বিয়ে হচ্ছে দুজনের। আসলে কি তাই? বিয়ে কখনও দুজনের হয় না, হয় দুটো পরিবারের। আর এরা বিয়ের পর থেকে অপরজনের পরিবারকে আপন করতে পারে না বলেই সম্পর্কে সমস্যার সৃষ্টি হয়। একটা ছেলে কখনও তার পরিবারকে ছেড়ে ভাল থাকতে পারবে না। ঠিক তেমনি একটা মেয়ে তার পরিবারকে অসম্মান করা ছেলেটাকে মন থেকে সম্মান করতে পারবে না। আজকাল সবকিছু আধুনিক হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, আমরা সামাজিক বন্ধনের সংজ্ঞা ভুলতে বসেছি। সমাজে থেকে সামাজিকতা কে অস্বীকার তো করা যায় না, প্রত্যেকটা সামাজিক/ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো আমরা আমাদের কৃষ্টি কালচার ধরে রাখার জন্য হলেও যার যার জায়গা থেকে কিছুটা তো পালন করছি। পরিবারের হয়ে একই পরিবারের লোকজনকে কিকরে অস্বীকার করা যায়, গেলেও তা কতটা সম্পর্ক ধরে রাখতে সাহায্য করবে? বাবা-মায়ের অসম্মান করা ব্যক্তিকে কতটা আর ভালবাসা বা সম্মান করা যাবে? হয়তো বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে কিছু সময় একজন মানুষ কিছুটা কম্প্রোমাইজ করবে, চেপে রাখতে চেষ্টা করবে সমস্ত কান্না, রাগ, ক্ষোভ কিন্তু একটা না একটা সময় এটা তো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই।

পারিবারিক বন্ধন মানেটা আসলে কী? পরিবারের কাছ থেকে আপনি যতটাই দূরে পালান না কেন, নাড়ীর বাঁধন কাটিয়ে আপনি বেশি দূর যেতে পারবেন না! আমরা ভুলে যাই, হাতের পাঁচটা আঙ্গুল এক না। প্রতিটা আঙ্গুলের কাজও আলাদা আলাদা। তবু আমরা কিকরে আশা করি পরিবারের প্রতিটা মানুষ এক হবে, এরা একি রকম কাজ করবে। দোষত্রুটি কি আমাদের সবার পরিবারে নাই? যদি থেকেই থাকে, তবে কেন এতো অভিযোগ? নিজ নিজ পরিবারে তো আমরা মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি, কখনও ভালবেসে, কখনোবা শাসনে। এভাবে তাহলে অন্য পরিবারে যতটা সম্ভব মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা দিয়ে শুরু তো করা যায়। ভালবাসলে ভালবাসা পাওয়া যায়, সহজ হিসাব। জানি অনেকেই একমত হবেন না, হতেই পারে আপনি অনেক চেষ্টা করে ক্লান্ত। কিন্তু আমি কোথাও একার চেষ্টার কথা বলছি না। পরিবার যদি সবার হয়, চেষ্টাও সবার মিলেই করতে হবে। যে মেয়েটা সমস্ত কিছু ছেড়ে আপনার পরিবারে এসেছে, আপনারও উচিত পরিবারের সবাইকে নিয়ে সে মেয়েটার সাথে থাকা। আবার মেয়ে হিসেবে আপনার উপরও দায়িত্ব বর্তায় এক সম্পূর্ণ অচেনা এক পরিবারকে আপন করে নেয়ার। এটাই তো প্রকৃতির বিশাল দান আমাদের প্রতি, আমরা মায়া দিয়ে আবদ্ধ করতে পারি সবাইকে।

পরিবারে থেকে পরিবারকে অস্বীকার করা বোকামি, বরং পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললে পথ অনেকটাই সরল হয়। নিজেদের বাদ দিয়ে যদি একটু সন্তানদের কথাও ভাবেন, দেখবেন যৌথ পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি আন্তরিক আর মিশুক হয়। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন। দাদু, দিদা, কিংবা কাকা, মামা, অর্থাৎ একটা পরিবারে প্রতিটা সদস্যের ভালবাসায় বেড়ে উঠা সন্তান কখনও বড়দের অসম্মান করতে শিখে না। একসাথে থাকার নানা অসুবিধার মধ্যে সুবিধাও নিছক কম না। কিছু ব্যাতিক্রম সব কিছুতেই থাকবে, সেটাকে সময় বিশেষ এড়িয়ে চলতে হয়।

তবে এ সাথে এটাও সত্যি, ভালমন্দ মিলিয়েই সংসার তবু মন্দটা সব নারীর কাঁধে। এই বড় অদ্ভুত রসায়ন, জীবন কেটে যায় পরের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে। কঠিন হলেও সত্যি নিজের বলে আসলে নিজের আর কিছুই থাকে না। বিয়ের পর নিজের আপন বাবা মা, ভাই বোনও না। এবার আসি মূল কথায়, খোলা চোখে সংসার দেখতে গেলে গোলকধাঁধায় বাঁধা পড়তে হয়, বড্ড বিশ্রী আর একঘেয়ে হয়ে যাবে জীবন।

আমি তাই সংসার দেখি আমার মনের রঙ মিশিয়ে। এখানে সব আমার, এই পর… এই ঘর…সব আমার। এভাবে দেখি যখন সব আপন মনে হয়, হঠাৎ ঘন মেঘ কাটিয়ে রোদেলা ঝলমলে সকাল এসে যায়। বিস্তর মন খারাপ, বিস্তার নেয় ভীষণ ভাললাগায়। অন্যের মুখের ঝাল বা মিষ্টি কোনটার স্বাদ নিতে আমি মোটেও স্বস্তিবোধ করি না। জীবন আমার, কীভাবে দেখবো সেটাও একান্ত আমার।

কৃষ্ণা দাশ
পশ্চিমবঙ্গ, নদীয়া।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.