ফারদিন ফেরদৌস:
দেখেন তো এবার আপনার মন প্রশান্ত হলো কি না? সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহার মারা গেছেন! আপনাকে ঠোঁট বাঁকিয়ে আর বলতে হচ্ছে না, ছিঃ ছিঃ এমন বিয়ে কেউ করে? কী রুচি!
মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে একটি বাজে প্রবণতা চালু আছে। কেউ যদি প্রেম করে বিয়ে করে, আবার সেটা যদি হয় অসম প্রেম -তবে ওই সন্তানকে অনার কিলিং -এ শেষ করে দিয়ে পরিবারের মান ইজ্জত রক্ষা করা হয়।
এই সভ্য সমাজে, বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চায় শুদ্ধাচার এবং সভ্যতা রপ্ত করার যুগে এখনও মানুষ আপন সন্তানকে নিজের হাতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়! এও সম্ভব।
এমন বাস্তবতায় একশ্রেণীর বাঙালি খায়রুন নাহারের প্রেম ও বিয়েকে মেনে নিতে পারেনি। মুখে যা এসেছে সেই ভাষাতেই ওই দম্পতিকে নিন্দামন্দ করেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে দোষারোপ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা খবরের মন্তব্যের ঘরে গিয়ে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা গালমন্দ করে এসেছে।
একবার ভাবা যেতে পারে ওই নারীর পরিবার ও তাঁর কর্মস্থলের সবাই এই শিক্ষকের সাথে কী দুর্ব্যবহারটাই না করেছে! উপর্যুপরি তিরস্কার করেছে। ওই শিক্ষকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও কি প্রকাশ্যে টিপ্পনি কাটছিল? হতে পারে। বাঙালি সমাজব্যবস্থা এখন যেখানে এসে উপনীত হয়েছে -এটা অস্বাভাবিক না। যেখানে খোদ সতীর্থ শিক্ষকেরাই তির্যক মন্তব্য করতে ছাড়ে না, সেখানে বাচ্চারা সংবেদনশীল হবে -এটা আশা করা ভুল।
প্রেমিক আর দাম্পত্যসঙ্গী এক নয়। এক ছাদের নিচে বসবাস না করলে মানুষ চেনা যায় না। এরইমধ্যে সুমনের সাথেও খায়রুনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠেছিল কি? হতেও পারে।
যাইহোক খায়রুন নাহার অসম বয়সী সুমনকে নিয়ে যেভাবেই সংসার করুক না কেন, সভ্য সমাজ হলে কেউ মাথা ঘামাত না। কিন্তু জাতিগতভাবেই আমাদের নাসিকা এত লম্বা যে, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে ওই নাক না গলিয়ে আমরা বাঁচি না। এরমধ্যে আমাদের মিডিয়াগুলো হয়েছে আরেককাঠি সরেস। সমাজে প্রতিক্রিয়া হওয়া চটুল কোনো সংবাদ পেলে নিমিষেই তা ভাইরাল করে দেয়। এতে কাঁচা রোজগার যেমন বাড়ে মিডিয়ার র্যাংকিংও ওপর দিকে ওঠে। আর তাই মিডিয়াও এখন ন্যূনতম নৈতিকতার ধার না ধেরে মানুষের আবেগ অনুভূতি বিক্রি করে নিজেদের ঠাটবাট বজায় রাখে। নিশ্চিতই ধরে নেয়া যায়, খায়রুন-সুমন দম্পতির বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার মিডিয়াই উস্কে দিয়েছে। এই দম্পতিকে মানসিকভাবে আঘাত করবার রসদ জুগিয়েছে।
শিক্ষক খায়রুন নাহার কলেজ ছাত্র সুমনকে বিয়ে করে সাহস দেখিয়েছিলেন। প্রত্যয়ের সাথে বলতে পেরেছিলেন, মন্তব্য কখনো গন্তব্য ঠেকাতে পারে না। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। মানুষের ক্রমাগত মন্তব্য একটা নিটোল সুন্দর জীবনের প্রদীপ গলাটিপে হত্যা করলো। অথচ এখানে যদি ছেলেটি কলেজ শিক্ষক হয়ে মেয়েটি ছাত্রী হতো কারও মুখে কোনো ‘রা’ থাকত না। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মগজের এই একপাক্ষিক মাইন্ডসেটিং যুগ যুগ ধরেই গড়ে ওঠেছে। এখানে আমাদের অধঃপাতিত বোধের উত্তরণ হয়তো কখনই ঘটবে না। আমরা অদ্যাবধি নারী-পুরুষের সাম্য ও সমানাধিকারের সমাজ বিনির্মাণ করতে পারিনি। আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতা সেটা করতে দেয়নি।
ধর্মীয় বাতাবরণে অনারকিলিং এর বেতাল মর্যাদা পুষে রাখা সমাজ সহসা বদলাবে এমনটা আশা করাও বাতুলতা।
কাজেই খায়রুনের মৃত্যুর দায় সমাজের, মিডিয়ার এবং আমাদের সবার। মিজ খায়রুন নাহার এই সমাজ কোনোদিনই আপনার ছিল না। তাই এখানে আপনি বেমানানই রয়ে গেলেন। মানবতাবিরোধী গসিপটুকুই শুধু আমাদের সামগ্রিক অর্জন হয়ে রইল।
লেখক: সাংবাদিক
১৪ আগস্ট ২০২২