ঈহিতা জলিল:
বেশ কিছুদিন ধরেই মাথায় কিছু বিষয় ঘুরছিলো।
এরমধ্যে মেয়েদের আবেগজনিত বিষয়টি অন্যতম।
আমাদের মেয়েরা শিক্ষিত তো হচ্ছে কিন্তু স্বনির্ভর হতে পারছে কি? আমার মনে হয় মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সাথে সাথে আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণ আসাটা এখন সময়ের দাবি।
আসলে আমি ভাবছিলাম, মেয়েদের মাথা থেকে প্রেমের ভূত কীভাবে নামানো যায়! বুঝতে পারছি না! আগেই গালি দিয়েন না ভাই ও বোনেরা। আমিও প্রেম করেছি, কথা সত্য। কিন্তু আমাদের যখন প্রেমের বয়স ছিলো। বাসা থেকে শুধু বলা হয়েছিলো প্রেম করা যাবে না! কিন্তু কেনো করা যাবে না এটার কোন যৌক্তিক কারন যৌক্তিকভাবে কেউ বলেনি!
আম্মুর চার নম্বর চাচা, জিন্নাত আলী নানা আমাকে সবসময় বলতেন, “আমার নাতিন কোটিতে একটা”, আমার সোনার নাতিন”! নানা যে আমার সবকিছু নিয়ে অনেক গর্বিত ছিলেন এটা আমি বুঝতাম। প্রতিবার দেখা হলে, সব কথা বলে, অনেক অনেক দোয়া দিয়ে, সব শেষে প্রতিবার একটাই ট্যাগ লাইন থাকতো, “বইনে, পেমপুম কইরো না কইলাম!”
যাই হোক, মেয়েদের কেনো প্রেম করা উচিত না?এটা নিয়ে আমি বিশদভাবে ভেবেছি। আমাদের কেউ এভাবে বলেনি। আমার মনে হলো আমি বলি। তাহলে অন্তত্য আমি ভাবতে পারবো আমি তো বলেছিলাম!
প্রথমত, ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই প্রেম একটি সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু না! বিশেষ করে স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার সময়টা খুবই গুরত্বপূর্ণ। এই সময়ে আবেগীয় সম্পর্কে জড়ালে দুইজন ছাড়া আর কিছু চোখে দেখা যায় না। অথচ, জীবনের এই সময়টাতে যত মানুষের সাথে মেশা যায়, বই পড়া যায়, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিসে সময় দেওয়া যায়, পরবর্তীতে সেটি আর হয়ে ওঠে না।
এতো গেলো সবার কথা। কিন্তু খুব নির্দিষ্ট করে মেয়েদের কথা এর জন্য বলতে চাই, আমার মনে হয় মেয়েরা সহজে “মুভ অন” করতে পারে না। একটা সম্পর্কে জড়ালে তাঁরা তাতে এতোটাই জড়িয়ে যায়, এর বাইরেও যে একটা পৃথিবী আছে সেটা তাঁরা ভুলে যায়। ঐ সম্পর্কটাকেই নিজের পৃথিবী বানিয়ে ফেলে। আর যখন ঘুম ভাঙে তখন চারিদিক নিকষ কালো আঁধারে আচ্ছন্ন।
আমি অনেক উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক নারী দেখেছি যারা অনায়াসে স্বামীর পরকীয়া মেনে নিয়ে একই বাসায় আলাদা ঘরে জীবন কাটাচ্ছে কিন্তু ডিভোর্সে যাচ্ছে না। আবার ডিভোর্সের পরেও অতন্ত্য সফল কর্মজীবন থাকার পরও “কী জানি কিসেরো লাগি প্রাণো করে হায় হায়” একটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে খুব সন্তর্পণে একে ঢেকে রাখেন বটে তবে অভিজ্ঞতার চোখে ধরা পরেই যায়!
কিশোরী/তরুণী মেয়েদের আমি বলতে চাই আপনারা আগে নিজের ভবিষ্যত নিশ্চিত ও নিরাপদ করুন। আপনার ভবিষ্যত আপনার পড়ালেখা আর গুণ। এই সমাজ মেয়েদের পক্ষে কোনোদিন ছিলো না। নিকট তো নয়ই, অদূর-সুদূর ভবিষ্যতেও পক্ষে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তাই আপনার ভবিষ্যত আপনাকেই তৈরী করতে হবে। কারন যে কাজগুলো আপনি আপনার এই সোনালি সময়ে করতে পারবেন সংসার জীবনে ঢুকে গেলে পারার সম্ভাবনা ১%। এমন নয় যে স্বামী, পরিবার সহযোগিতা করছে না বলে আপনি পারবেন না। এর বাইরেও বহু কারন আছে। যারমধ্যে আপনার শরীর অন্যতম। আপনার শরীর সবসময় আপনাকে সঙ্গ নাও দিতে পারে। জীবনের একেকটি ধাপে মন ও শরীরকে আপনি একেবারে চমকে দেবার মতো একেকটি জায়গায় আবিষ্কার করবেন।
প্রতিবার সন্তান জন্মদানে নারীর শরীরের যে ক্ষয় হয় সেটি পূরণ হতে বহু সময় লেগে যায়। সন্তান ধারণ থেকে জন্ম দেওয়া ও তার পরবর্তীতে যে শারীরিক-মানসিক ক্ষয় তা আমার তো মনে হয় অপূরণীয়। এরইসাথে প্রায় প্রতিটা নারীর জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও “গর্ভপাত” নামের ব্যাপারটির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। আর মাসে মাসে পিরিয়ডের ব্যাপারটি তো আছেই। এই পিরিয়ড আবার জীবনের একেক বাঁকে একেক রূপ দেখাতে ওস্তাদ! তারপর একদিন শুরু হবে মেনোপজ পূর্ববর্তী এ্যালার্ম বাজা এবং মেনোপজ। এর সঙ্গে নিয়মিত রোগ বালাই তো আছেই।
এসব একটা ব্যাপারের মধ্যে দিয়েও কিন্তু ছেলেদের যেতে হয় না। এটা ঠিক তাদেরও টিনেজ ও মিড-লাইফ ক্রাইসিস আছে। সে আবার আরেক গল্প।
আমি যতটা বুঝেছি, মেয়েরা অনেক গভীর চিন্তা করতে পারে। ছেলেরা সেটি পারে না। আমাদের যোগ্য ও মানসিকভাবে শক্ত নারীর খুব প্রয়োজন।বিভিন্ন কারনে আমি অনুভব করলাম আমাদের শিক্ষিত নারীর সংখ্যা তো বাড়ছে কিন্তু তাদের শিক্ষা শুধুমাত্র-ই সার্টিফিকেট কেন্দ্রীক। সমাজ পরিবর্তনে খুব একটা সহযোগী ভূমিকা তাদের নেই।
সবচাইতে দুঃখজনক তারা নিজেদের জীবনের শূণ্যতা পূরণ করতে ঘুরেফিরে পুরুষের কাঁধকেই আশ্রয় হিসেবে নিচ্ছেন! মানে, এক পুরুষের কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে আবার আরেকজন পুরুষকেই তারা তাদের ঢাল-তলোয়ার বানাচ্ছেন। এখানে আমার বেশ আপত্তি আছে। আমি চাই আমাদের মেয়েদের যেনো এর প্রয়োজন না হয়।
জীবনে অনেক সম্পর্ক আসবে-যাবে কিন্তু দিনশেষে নিজের পিঠ চাপড়ে দেবার জন্য যেনো আমাদের মেয়েরা নিজেরাই যথেষ্ট হয়। আর ঠিক এই কারনেই মেয়েদের আবেগের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দরকার।
নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে বলি, আমার স্বামীর বিরূদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ থাকতে পারে। তাঁরও নিশ্চয়ই আছে। আমরা কেউ পারফেক্ট না। কিন্তু আমার কোন কাজে তিনি কখনো বাঁধা দেননি বা সমস্যা তৈরী করেননি বরং সহযোগিতা করেছেন। তারপরও আমি যা যা করতে পারতাম সেগুলোর ৯৯% কাজ করতে পারিনি। কারন আমার শরীর সাপোর্ট করেনি। এখন তো একদম-ই করে না।
ঐ যে ভুল বয়সে, ভুল সময়ে প্রেমের আবেগে জড়িয়ে জীবনের সোনালী সময় আমি নষ্ট করেছি।
আমরা এমন খবর আর লিখতে চাই না, দেখতে চাই না।
” প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা”!
“স্বামীর পরকীয়ার কারনে স্ত্রী হত্যা”!
“যৌতুকের বলি নববধূ”!
এমন আরো অনেক অনেক বিষয়!
তাই, শুধু শিক্ষিত হলে হবে না সমাজের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার মতো সততা, সাহস থাকতে হবে। মরে তো একদিন যাবোই কিন্তু যুদ্ধ করে জিতে যাওয়ার মজা কেনো ছাড়বো?
কোথায় যেনো দেখলাম, জীবনের সবচাইতে বড় কষ্ট হলো সেই অনুভূতির অনুভব, যে আপনার মধ্যে সম্ভাবনা আছে কিন্তু আপনি কিছু করতে পারছেন না!
আজকাল আমি এই কষ্টে ভুগি।
আমি চাইনা আমার পরের প্রজন্মের একটি নারীও এই কষ্টে ভুগুক।
বিষয়টা কিন্তু এমন নয় যে আমি প্রেম, সংসার, সন্তানের বিপক্ষে আমি মেয়েদের নিজ যোগ্যতায় পায়ের নীচে শক্ত মাটি থাকার পক্ষে।
প্রেম থাকবে, সম্পর্ক থাকবে, সব থাকবে
কিন্তু মেয়ে, সবার আগে তুমি নিজে থাকবে।
ঈহিতা জলিল
১৬.০৮.২২
মঙ্গলবার
রাত- ১১.১৫ মিনিট