প্রজনন স্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

climate changeসুপ্রীতি ধর: বাগেরহাট জেলার সাউথখালির তাফালবাড়ির মেয়ে সালমা বেগম। পরিবারের আর্থিক কষ্ট কিছুটা হলেও দূর করতে চিংড়ির পোনা সংগ্রহের কাজে যোগ দেন। প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘন্টা তিনি একাজ করতেন।কিন্তু প্রথমবার অন্ত:সত্ত্বা হওয়ার পর তিনি এই বাড়তি চাপটুকু নিতে পারছিলেন না।কিন্তু অভাবের সংসারে কাজটা ছাড়তেও পারেননি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মৃত সন্তানের জন্ম দেন। এমনকি সন্তান জন্মের পরের দিনও তাকে কাজে যেতে হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, তাদের যদি অন্য কোন উপায় থাকতো, তবে এখান থেকে তারা চলে যেতেন।

মমতাজ বেগম, বরিশালের মধুপুরু উপজেলার রাজাপুর গ্রামের গৃহবধু, দুই সন্তানের মা। ২০০৯ সালে আইলার পরপর সব দোকানপাট-ফার্মেসি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জন্মনিরোধক কোন পদ্ধতিই নিতে পারেননি। আবারও গর্ভবতী হয়ে পড়েন তিনি। ঝড়ে পুরো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি শেষপর্যন্ত অপুষ্টিতে আক্রান্ত এক শিশুর জন্ম দেন।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাতৃস্বাস্থ্য হচ্ছে মায়ের গর্ভকালীন স্বাস্থ্য, সন্তান জন্মদান এবং জন্মপরবর্তী সময়টুকু। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ ৩৬ হাজার নারীর মৃত্যু হয় গর্ভকালীন জটিলতায় এবং প্রসব-পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যে। অথচ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অনুযায়ী মাতৃমৃত্যু হার শতকরা ৭৫ ভাগ কমিয়ে এনে মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো এবং সেইসাথে প্রজনন স্বাস্থ্যে বৈশ্বিক প্রবেশাধিকার অর্জন করা।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মাতৃস্বাস্থ্যে এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়ের স্বাস্থ্য খারাপ থাকায় প্রায় ৩০ লাখ শিশুমৃত্যুর কারণ হয়। অপুষ্টি, বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশ এবং সংক্রমণযোগ্য রোগ বিস্তারের ফলেই মায়ের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায়।

মানুষ এবং তাদের স্বাস্থ্যের ওপর বৈশ্বিক পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি এখন পরীক্ষিত সত্য। বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে। আর এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে নারী স্বাস্থ্যের ওপর এবং নারীর জীবনে। তাছাড়া মানুষের উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে, সামাজিক ও অর্থনেতিক উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র জনগণ, যারা সুষ্ঠু স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত, তাদের ওপরই এর প্রভাবটা মারাত্মক আকার নিচ্ছে।

গত এক দশকে সিডর-আইলার মতো ভয়াবহ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে দেশ, যার ভয়াবহ পরিণাম এখনও ভোগ করছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ।

ভৌগোলিক অবস্থান, বর্ধিত জনসংখ্যা ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে এমনিতেই দেশটি অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তন এ সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তুলছে। আর এর সবচেয়ে নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে নারী ও শিশু।

১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে নিহত এক লাখ ৪০ হাজার মানুষের মধ্যে ৭৭ শতাংশই ছিলেন নারী। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় আক্রান্তদের ৭৩ শতাংশই নারী।

ইউএনএফপিএ’ এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, গর্ভবতী নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

২০০৯-২০১০ সালে খুলনার দাকোপ উপজেলার ১৩ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৩৪৫ জন অন্ত:সত্ত্বা নারীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত নোনা পানি গ্রহণের ফলে নারীদের উচ্চ রক্তচাপ, জরায়ুর প্রদাহ, গর্ভকালীন খিঁচুনি, গর্ভপাত, এমনকি অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার আশংকা বাড়ছে। তাছাড়া দুর্যোগ পরবর্তী বিশুদ্ধ পানির অভাবে দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ রকমের চর্ম ও যৌন সমস্যা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিবেশ স্বাস্থ্য বিষয়ক সিনিয়র কনসালটেন্ট ড. সালামাত খন্দকার একটি পত্রিকাকে সম্প্রতি বলেন, উপকূলীয় এলাকায় পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। অধিকাংশ গর্ভবতী নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের শিকার হচ্ছে, আনুষঙ্গিক অন্যান্য জটিলতা তো আছেই। তিনি বলেন, সদ্যজাত শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার দুটোই বেশি ওইসব এলাকায়। হাইপারটেনসন এবং প্রি-অ্যাক্লাম্পশিয়ার ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা নারীদের যকৃতেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, ফলে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সবারই মত, উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে নারী স্বাস্থ্যে। অকাল গর্ভপাত, পুষ্টিহীন শিশুর জন্মদান, এমনকি মায়ের মৃত্যুও ঘটছে প্রায়ই।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারীদের বিপন্নতার মাত্রা বেশি হওয়া সত্ত্বেও অভিযোজনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট ও ফলপ্রসু হিসেবে প্রমাণিত। এসব বিবেচনা করেই সরকার ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র ও কর্মপরিকল্পনা (বিসিসিএসএপি) প্রণয়ন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় এ ধরনের জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথমসারির একটি দেশ।

এদিকে সরকার এক লাখ ৩৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে উপকূলীয় গ্রামগুলোতে। এতে করে কমিউনিটি স্বাস্থ্য নিশ্চিত হচ্ছে অনেকখানিই। সেইসাথে প্রজনন স্বাস্থ্যও।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেছেন, সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব এবং বিদ্যমান নীতিমালাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়াই বর্তমান পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে গর্ভপাতের এক বিশাল যোগসাজশ রয়েছে, এটি গবেষণার দাবি রাখে। সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে প্রজনন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। কোন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে সবাই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নেয়, কিন্তু  কেউ পরিবার পরিকল্পনা, জন্মনিরোধক ব্যবস্থা এবং গর্ভাবস্থার সুযোগ-সুবিধাগুলো গ্রহণ করে না। যেকোনো জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় জন্মনিরোধক পদ্ধতি অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে বলে তিনি জোরারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, নারী হচ্ছে এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবচেয়ে ভাল প্রতিনিধি এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজন আধুনিক জলবায়ু উন্নয়ন।

শুধু যে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়ই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে, তা নয়। বৃষ্টির ধরন পাল্টে যাওয়ায় দেশের কোন কোন অংশে খরাও দেখা দিচ্ছে। আর এর প্রভাবে মৃত্যু, অপুষ্টি, সংক্রমক রোগ এবং শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা বাড়ছে। খরার কারণে সৃষ্ট খাবারের অভাব থেকে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অংশে। এর ফলে বাড়ছে মৃত্যুহার। এর সাথে যোগ হচ্ছে মশাবাহিত রোগবালাই।

ড. আতিক তার ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং ইটস ইমপ্যাক্ট অন হেলথ ইন বাংলাদেশ’ গবেষণায় দেখিয়েছেন, দাবদাহের প্রভাবে হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতা এবং বৃদ্ধদের ক্ষেত্রেো হৃদরোগের প্রকোপ বাড়ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের পানি এবং এর লবনাক্ত পরিবেশের সাথে কলেরা জড়িত। সাধারণত বন্যার পরপরই কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে।

তবে এতোকিছুর পরও আশার কথা শুনিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যুগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব ও সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়ার মতো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হলে বাংলাদেশের পক্ষে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠা অসম্ভব নয়। আর এতে সম্পৃক্ত করতে হবে পুরো কমিউনিটিকে। আর এজন্য চাই আইন প্রণেতা এবং কর্মসূচি নির্ণয়কদের একসাথে পরিকল্পনামাফিক কাজ করা, যেখানে কমিউনিটি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অংশগ্রহণ থাকবে সর্বস্তরে।

সূত্র: ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.