শান্তা মারিয়া:
যখনি ‘অসম বিয়ে’ শব্দটা শুনি পিত্তি জ্বলে যায়। কারণ ‘অসম’ শব্দটি শুনলেই আমার জানতে ইচ্ছা করে সমতার মানদণ্ডটা কী? দুজন মানুষের বয়স সমান হতে হবে? আর্থিক অবস্থা সমান হতে হবে? মেধা সমান হতে হবে? নাকি রুচিতে সমান হতে হবে? একজন যদি আমেরিকান, আরেকজন আফ্রিকান হন, তাহলে কি অসম বিয়ে না সমতার বিয়ে?
আচ্ছা প্রশ্নটি আপাতত মুলতবি রাখি। কারণ আমাদের দেশে অসম বিয়ে বলতেই বোঝায়, নারী-পুরুষের মধ্যে বয়সের বিশাল ব্যবধানকে। সেটাও আবার পুরুষের বেলায় খুব একটা নয়। অনেক ৩০ বা ৪০ বছরের পুরুষ অনায়াসে ১৮ বা ২০ বছর বয়সের নারীকে বিয়ে করেন। নারী ও পুরুষের মধ্যে পুরুষটি যদি ১০, ১৫ বা ২০ বছরেরও বড় হন তাহলে অসম শব্দটি খুব একটা উচ্চারিত হয় না।
কিন্তু নারীটি যদি চার পাঁচ বছরেরও বড় হন তো আর রক্ষা নেই। সেই দম্পতিকে নিয়ে শুরু হবে ঠাট্টা, তামাশা।
আরও কথা আছে। যদি ২০ বছরের কোন তরুণী ৪০ বছরের কোন বিবাহিত লোককে বিয়ে করেন এবং লোকটির যদি আগের স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে থাকে তাহলে সব দায় চাপে তরুণীটির উপর। বলা হয় সে ‘ঘর ভেঙেছে’। আরও বলা হয়, ‘প্রতিষ্ঠিত লোক পেয়েছে, ব্যস আর কোনদিকে তাকায়নি।’ কখনও বলা হয় না ‘বাচ্চা মেয়েকে ভুলিয়ে বিয়ে করেছে ওই লোক’। বরং লোকটির ডিভোর্সের জন্য দায়ী করা হয় তরুণী নারীটিকেই। আর যদি উল্টো চিত্র দেখা যায়। একজন বিবাহিত অথবা অবিবাহিত ৩০ বা ৪০ বছরের নারী তার চেয়ে অনেক কম বয়সী বা অল্প কম বয়েসী ছেলেকে বিয়ে করে তো আর দেখতে হবে না। ‘কচি ছেলের মাথা খাওয়ার অপরাধে’ নারীটির সামাজিক বিচার আচার শুরু হয়ে যাবে।
এটা বাংলাদেশের পুরনো চিত্র অনেক বছর ধরেই। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মিডিয়া।
সম্প্রতি একটা ঘটনায় মেজাজটা বিগড়ে গেছে। একজন নারী ৪০ বছর বয়সে বিয়ে করেন ২২ বছরের এক ছেলেকে। সেটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা, টিকা টিপ্পনী, ট্রল। তিন চারদিন আগে তার মৃত্যু হয়েছে। হত্যা না আত্মহত্যা তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। সেটা নিয়েও চলছে ট্রল।
ওই নারী আত্মহত্যা করেছেন না তাকে হত্যা করা হয়েছে তা আমি জানি না। সেটা আইন বলবে। কিন্তু যদি আত্মহত্যা করে থাকেন, তাহলে বলবো, এইসব নিউজ আর ট্রলের ঠেলাতেই করেছেন। এই সমাজ তাকে বাঁচতে দেয়নি।
বাংলাদেশে অনেক পুরুষই ৩২ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে করেন। যে নারীদের তারা বিয়ে করেন তাদের অনেকেরই বয়স থাকে ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে। সেখানে তো সেটা নিউজ হয় না। একজন ৪০ বছর বয়সী পুরুষ ২২ বছরের কোন মেয়েকে বিয়ে করলে কি নিউজ হয়? হয় না। তাহলে ৪০ বছরের নারী বিয়ে করেছেন বলে এতো কেন আলোচনা?
এটা নিয়ে নিউজ করারই বা কী ছিল? মিডিয়ার কি আর কোন কাজ নেই? দেশে তো সমস্যা, সংকট, ভালো খবর, খারাপ খবরের অভাব নেই। তাহলে কে ৪০ বছর বয়সে বিয়ে করলো, কার হাজবেন্ডের বয়স কত, কে কার চেয়ে ছোট, কে কার চেয়ে বড় সেটা নিয়েও নিউজ করতে হয়?
আমি নিজে ২৫ বছর ধরে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে কাজ করছি। সাংবাদিকতা আমার পেশা। কিন্তু এই যে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে গসিপ নিউজ করা এমনটা দেখে লজ্জা অনুভব করি। মনে হয় এই কি সাংবাদিকতা?
আমাদের দেশের আইনে কি কোথাও লেখা আছে যে কোন নারী ৪০ বছর বয়সে বিয়ে করতে পারবে না? কোথাও লেখা আছে যে হাজবেন্ড বয়সে যদি ছোট হয় তাহলে সেটা অপরাধ?
ওই শিক্ষিকা কি কোন ক্রাইম করেছিলেন? কেন তাকে নিয়ে এত নিউজ, এত আলোচনা?
এটা এমন একটা সমাজ যে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক না গলিয়ে থাকতে পারে না। অনলাইনগুলো লাইক, কমেন্টের পিছনে, ভাইরালের পিছনে দৌড়ে এ প্রবণতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।
আমি এই প্রবণতাকে ঘৃণা জানাচ্ছি। আমাদের দেশে ঘোরতরভাবে রুচির সংকট চলছে। অপরের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো ছাড়া আর যেন কারও কোন কাজ নেই।
নিন্দা, ঘৃণা, লজ্জা এমন সাংবাদিকতার প্রতি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা কী আর বলবো! সকলেই সবজান্তা শমসের। কোন নারীর চরিত্র হনন করতে পারলে তার চেয়ে রসালো আলাপ আর কিছু হয় না। সেটাও যদি হয় ক্ষমতাহীন নারী, তাহলে আরও মজা।
বর্তমান ফরাসী প্রেসিডেন্ট তার শিক্ষিকাকে বিয়ে করেছেন। ফরাসী প্রেসিডেন্টের জন্ম ১৯৭৭ সালে। আর তার স্ত্রীর জন্ম ১৯৫৩ সালে। এটা নিয়ে কিন্তু কেউ ট্রল করছে না। কিন্তু এমন ঘটনা যদি বাংলাদেশের সমাজে ঘটতো তাহলে সেই দম্পতির অবস্থা নাজেহাল করে দেয়া হতো টিকা টিপ্পনির মাধ্যমে।
কম বয়েসী হলেও নারীর দোষ, বেশি বয়সী হলেও নারীরই দোষ। সমাজটার কোন ইতিবাচক পরিবর্তন তো হচ্ছে না। বরং আরও যেন পিছন দিকে চলছে। শিক্ষাগত যোগ্যতায়ও যদি কোন নারী তার স্পাউসের চেয়ে এগিয়ে থাকেন তাহলেও যথেষ্ট টিপ্পনি ও মন্তব্য সহ্য করতে হয় তাকে। এই প্রসঙ্গে কয়েকদিন পর বলবো। আজ আমি সেই প্রয়াত নারী ও তার জীবিত সন্তানের কথা ভাবছি। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।