নারীর পোশাকে নারীর আপত্তি

মুসাররাত নাজ:

পোশাক কেন পরা হয়? এটা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু মাথাব্যথা আছে এ কেন ঐ পোশাক পরছে, ও কেন পরলো না! নিজের বেলায় ব্যক্তি স্বাধীনতা বোঝেন, অন্যের বেলায় কেন বোঝেন না??

কেউ স্লিভলেস পরেছে। আপনি দেখুন। ব্যস্ ঘটনা শেষ। দেখতে যদি ভালো লাগে তাহলে তো মিটেই গেল। আর না ভালো লাগলেও কি কিছু করার আছে? যেমন হিজাব দেখতে কারও কারও ভালো লাগে না। তাই বলে কি সে অন্যের হিজাব খুলে নিবে? কেউ কেউ স্কার্ট পছন্দ করে না। সে নিজে না পরলেই তো হয়! কারও দাঁড়িওয়ালা, গোঁফওয়ালা কাউকে দেখলেই বিরক্ত লাগে। এবার কি এদের দাঁড়ি উপড়ে নিবে? অথবা মারজুক রাসেল একটা ট্রাউজার পরেন বারমুডা প্যান্টের নিচে। কী যে অসহ্য লাগে দেখতে! কিন্তু তাতে আমার কী? উনি নিশ্চয় এই পোশাকে এমন কিছু কমফোর্ট পান, তাই পরেন।

আমি জানি, আমার পছন্দে দুনিয়া চলবে না। ব্যক্তিবিশেষে মানুষের সখ ইচ্ছা রুচি ভদ্রতাবোধ সৌন্দর্যবোধ আলাদা হবে। এই যে আমরা সবাই সবার থেকে আলাদা, এসব জানি কিন্তু মানি না, এটাই অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে।

বলা হয়ে থাকে, পুরুষ নারীকে কাপড়হীন দেখতে পেলেই নাকি খুশি হয়। তাহলে অল্প কাপড়ে দেখে খুশি হয়ে আবার অভিযোগ করা কেন?
আবার কাপড় ছাড়া যেহেতু সভ্য সমাজে চলাচল করা সম্ভব হয় না, তাই কাপড় পরেই থাকে সবাই। তো এই কাপড়ে ভ্যারাইটি থাকবে। গরম ঠান্ডা পরিবেশ পরিস্থিতি অভ্যেস ইত্যাদির উপর নির্ভর করে কাপড় পরবে। একই মানুষ পরিবেশের ভিন্নতার জন্যে ভিন্ন কাপড় পরবে। এই পরায় যদি আপনার কাছে কাপড়কে কম মনে হয় তো হলো। এতে কী সমস্যা? কেন সমস্যা?

একজনের কাছে যা কম বা অস্বস্তিকর, তা অন্যজনের জন্যে আরামদায়ক। আমি তো আরামদায়ক কাপড়ই পরি। সুস্থ যেকোনো মানুষই তাই করে থাকে।

এখন একটা সত্য উদাহরণ দেই কাপড়ের কম বেশির উপর। আমি বাড়িতে শর্ট হাতা এবং হাতাবিহীন জামা পরি। আমার এক আত্মীয় গরমে হাঁসফাঁস করছে দেখে আমি বললাম, এই গরমে ফুল হাতা জামা পরে থাকেন। বাসায় পরার জন্যে শর্ট হাতা বানালেই তো গরম কম লাগবে। আরাম পাবেন। উনি আমাকে বললেন, ‘ আমার ফুল হাতায় অভ্যেস হয়ে গেছে। ফুল হাতা না পরলে মনে হয় কী জানি নাই। আর তুমি যে ধরনের জামা পরো আমি এমন জামা পরলে বাঁচবো না।’ ভাবুন একবার… একজন মানুষ, একজন নারী, যার প্রথম কন্যা নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে, সেই ব্যথা সহ্য করতে পেরেছেন। কিন্তু শর্ট হাতার জামা পরলে মারা যাবেন। মাইন্ডসেটটা কী পর্যায়ের!
তিনি নিজে তো বাড়িতে ফুলহাতা পরেন, কন্যাদেরও পরান! বাচ্চাগুলার গরমের যন্ত্রণা আর ঘামাচি দেখে দুঃখ লাগে।

এবার আসি নারীর স্লিভলেসে পুরুষের বা অন্য নারীর সমস্যার কেন হয়!
পুরুষের তো দেখে ভাল্লাগে। এটা অস্বীকার করতে এবং খামোখা কন্ট্রোল করার মানসিকতা থেকেই বাধা দেয়। বা অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। আবার কিছু পুরুষ বলে, তার পছন্দের নারীর শরীর অন্য পুরুষ দেখছে এটা ভাল্লাগেনা বলে তার আপত্তি। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় আয়ত্বে রাখার চেষ্টা এবং সারাক্ষণ নিজের অক্ষমতা নিয়ে ভাবিত পুরুষ মনে মনে ভীত থাকে নারীকে হারানোর। আর এই ভয় থেকে সে চায় নারীকে সুন্দর কম লাগুক। অন্যের স্ত্রী প্রেমিকা সুন্দর হোক। সে দেখবে। কিন্ত তার প্রেমিকা/স্ত্রীকে কেউ না দেখুক। কেন জানি মনে হয় ওরা ভয় পায়, প্রশংসা শুনে তার থেকে অতৃপ্ত নারী যদি অন্য পুরুষে আকৃষ্ট হয় তো তার পৌরুষ আঘাতপ্রাপ্ত হবে।

আর নারীরা অপছন্দ করে তারও কারণ আছে অনেক।

-সুন্দর কাপড়চোপড় পরা নারীকে সুন্দর লাগে। স্মার্ট লাগে। কনফিডেন্ট দেখায়। এটা একটা সমস্যা।
-স্লিভলেস পরিহিত নারীর দিকে তার প্রেমিক বা স্বামী মনোযোগ দিচ্ছেন। চোখ ফেরাচ্ছেন না। সেই থেকে হিংসা হয়।
-তারও ইচ্ছে করে এমন কাপড় পরতে, কিন্তু পরতে পারেন না। তাই অন্যকে পরতে দেখলে গা জ্বলে। নিজের মনের এই দৈন্যতা তিনি ‘আমি পরি না, আমার ভাল্লাগে না, এটা অসামাজিক পোশাক, এসব ভালো মেয়েরা পরে না ‘–বলে কাটান।
-নিজে কূপমণ্ডুক।
-স্লিভলেস পরা যায়। তবে সবাইকে ভাল্লাগে না। পরার মতো শারীরিক সৌন্দর্য নাই বলেও অনেকে এটাকে সহ্য করতে পারে না।
আরও কারণ আছে, সব তো আর লেখা যায় না।

আরেকটা লেখায় আমি লিখেছিলাম, নারীই নারীর সামনে আগানোর পথে বাধা। এবার বলতে পারেন স্লিভলেস কী করে সামনে আগানোর রাস্তা? ব্যাপারটা স্লিভলেসের নয়, ব্যাপারটা হলো ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের। ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করায়। নারী হয়ে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা লালন করার। নিজের হিংসাত্মক আক্রমণে অন্য নারীকে হেনস্থা করা।

নারীকে যদি এখনও শাড়ি পরে চলতে হয় এই প্রতিযোগিতার বাজারে, এই দৌড়ের বিশ্বে, তো সামনে আগাবে কেমন করে? আর সেই পুরাতন আমলে যখন আমাদের দাদী বা দাদীর মায়েরা ব্লাউজ পরতেন না তখন তো সমাজ বা ধর্মের কোনো অসুবিধা হয় নাই। তখনও দেশে মুসলিমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তখনও সমাজে আব্রু প্রথা ছিল। তখনও সাধারণ ঘরের নারীরাও স্লিভলেস পরতেন। নাটক সিনেমা করতেন এই স্লিভলেস ব্লাউজ পরে। এর প্রমাণ আমরা পুরাতন ফটোগ্রাফে পাই। হাতা যেমন পোশাকের একটা ধরন। হাতাহীনতাও একটা ধরন। এটা মানতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারী শিক্ষিকা অন্য একজন কেবল নারী হয়ে উঠছেন এমন একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে শাড়ির সাথে শুধু স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছে বলে যে আচরণ করেছে তা সুন্দর স্বাভাবিক সমাজে কাম্য নয়। এই মেয়েটির মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণ হবার আগেই এমন অপমানের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় তার যে মানসিক ক্ষতি হলো তার দায় কে নেবে?
নারীই পারে নারীর সাহায্যে এগিয়ে এসে নারী মুক্তির দ্বার উন্মোচন করতে। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা।

মুসাররাত নাজ
১লা অগাস্ট,২০২০

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.