প্রিয়া দেব:
হিরো আলমের মতো কেউ কেউ এই জীবনে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবেন। আমরা যারা রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ করি তারা এইটা নিয়া চিল্লাবো, কাউকে ক্ষেপাতে হলে কানের কাছে হিরো আলমের রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে দিবো,কেউ ভুলভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলে হিরো আলমের অনুসারী হচ্ছে বলে ভবিষ্যত বাণী করবো, বয়সে একটু বড় যারা এরা একটু গুরুগম্ভীর আলাপ দিবেন।
কিন্তু একটা মানুষ অসহায়ভাবে কাঁচুমাচু হয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে আর কখনও রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবে না বলবে এই দৃশ্যটা কেনো আমরা দেখতে চাইবো?
এই যে সঙ্গীতের একটা ধারাকে রীতিমতো রিজার্ভ করে দেওয়া, এটা আদতেই সুস্থ কিছু না।
একটা মানুষকে রীতিমতো বাধ্য করা হচ্ছে গান গাওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে এই জিনিসটা আসলেই কি সুন্দর কিছু?
হিরো আলম এইরকম বিনোদন দিতেই গান গেয়ে থাকেন, তিনি জানেন তিনি ভুল গাইছেন, কিন্তু তারপরও লোকে তাকে নিয়ে মজা নিক এটাই তিনি চান। এই হিরো আলমের গাওয়া গানের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীতের কোনো অপমান হচ্ছে এটা আমি কখনোই মনে করি না, রবীন্দ্র সংগীত এতো ক্ষুদ্র কিছু না। আজকে হিরো আলম রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছেন বলে যারা গেলো গেলো রব তুলে হিরো আলমকে ক্ষমা চাওয়ালেন তারাই বরং রবীন্দ্র সঙ্গীতকে আজকে ক্ষুদ্র করলেন,তারা বুঝালেন হিরো আলমের মতো কেউ চাইলেই রবীন্দ্র সঙ্গীতকে অপমান করে ফেলতে পারেন। আসলে তাদের সমস্যাটা হয়তো হিরো আলমের মতো কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছেন সেখানেই। তারা সেট করেই রেখেছেন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে হলে কিছু ভারী ভারী যোগ্যতা থাকতে হবে, সুর-তাল-লয় হতে হবে যথার্থ, ভালো কোনো একাডেমী থেকে ভালো ডিগ্রী থাকতে হবে সঙ্গীতের উপর, সেইসাথে ভারিক্কি চালের চেহারা এবং গাম্ভীর্য নিয়ে গাইলে তবেই তবেই না সব ঠিকঠাক হবে। হিরো আলমের মতো প্রান্তিক মানুষকে বিনোদন দেওয়া একটা লোক যার কিনা এলিট সোসাইটির চাহিদার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা চেহারা কোনোটাই নেই, সে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে এটাই মেনে নেওয়া হয়েছে মুশকিলের ব্যাপার। আর এই মুশকিল আসানের জন্য একটা মানুষকে পুলিশের সামনে থতমত খেতে হয়,অসহায় ভাবে বলতে হয় আর কখনো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবেন না। এই জিনিসগুলো ভাবলে কেমন ঘেন্না হয় না?
আমাদের শিল্প হবে আকাশের মতো যেখানে সবাই উড়তে পারবে, এই যে ভাবনাটা এই ভাবনাতেই আঘাত করা হলো আজকে হিরো আলমকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানোর ফলে। আজকে রীতিমতো কোর্টে রিট করা হচ্ছে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে একঘরে করার জন্য। এইসব প্রমাণ করে আসলে হিরো আলম কিছুই করেননি, তার গাওয়া গানে রবীন্দ্রনাথ কিংবা তার গানের কিছু যায় আসেনি, গেছে আসছে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে একঘরে বানিয়ে নিজেদের সম্পত্তি দাবি করা কিছু মানুষের। হিরো আলম ওই মানুষদের আসলে নাড়িয়ে দিয়েছেন।
হিরো আলমকে তার এই চেষ্টার জন্য সমালোচনার সামনে ফেলা যায়, কিন্তু জেলে নিয়ে এইভাবে তারে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াতে বাধ্য করে যে ক্ষমতার জাহির করা হলো, এই ক্ষমতার নমুনা দেখলে আমার আসলেই ভয় করে। কোনদিন দেখা যাবে এই ক্ষমতার গৌরবে পরিপূর্ণ গোষ্ঠী স্বাধীনভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে আবিষ্কার করতে নামা মানুষগুলোকেও বাধ্য করবে তাদের ছকে চলতে, না চললে জেলে নিয়ে যাওয়ার নজির তো স্থাপন করেই দিলো তারা।
এদের সাথে আর মৌলবাদিদের সাথে আমি খুব একটা পার্থক্য আসলেই দেখতে পাই না, দিনশেষে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রসাহিত্য যেন ওই ধর্মগ্রন্থগুলোর মতোই পরিণত হচ্ছে,যাকে নিয়ে কিছু বলা যায় না, যার উপস্থাপনা হতে হয় সীমাবদ্ধ, একটু বদল ঘটলেই আমাদের অনুভূতি নামক সস্তা জিনিসটি সেখানে আঘাত পেয়ে যায়। এদের জন্যই একদিন হয়তো রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রিয় কোনো গানের দুয়েক লাইন গুনগুন করে গাইতেও আমরা ভয় পাবো।
কী অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে না আমাদের চারপাশটা?..