সালমা লুনা:
নাঈমা নার্গিস নামের এক নারী মারা গেলেন। মেডিকেলের ভাষায় এই মৃত্যু স্বাভাবিকই। কিন্তু ভেতরের ঘটনাটা জানলে নাঈমার চেনাজানা অসংখ্য মানুষের মতো প্রতিটি মানুষই বলবেন, এই মৃত্যু কিছুতেই স্বাভাবিক নয়। এটি স্বাভাবিক মৃত্যু হতেই পারে না । এটি হত্যা।
নাঈমা নার্গিস একজন মা, একজন নারী। যিনি স্বামীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার পর বাচ্চার জিম্মাদারি বা অভিভাবকত্ব চেয়েছিলেন। এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সেটি না হওয়ায় তিনি আইনেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
আইন আদালত পর্যন্ত গেলেও সেখানে এই ঘটনার কোন সুরাহা হয়নি। তিনি কোন সুবিচার পাননি। সত্যি বলতে আইন স্বাভাবিক গতিতে এগোয়ইনি। কারণ নাঈমার প্রাক্তন স্বামী, তার সন্তানের পিতা বিষয়টির নিস্পত্তি চেয়েছিলেন এক তরফাভাবে, তার পক্ষে। তাই তিনি আদালতে, শুনানিতে হাজিরই হননি। পরপর এমন হওয়ায় আদালত সমন জারি করলেও লাভ হয়নি কারণ সমনের বিষয়টা কার্যকর করার কথা ছিল পুলিশের। সেখানে পুলিশ তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেনি।
ইতিমধ্যে নাঈমা জানতে পারেন তার সন্তানকে নিয়ে দেশ ছাড়ার পঁয়তারা করছেন তার প্রাক্তন স্বামী।
নাঈমা আবারও পুলিশের কাছে যান। এমনকি ইমিগ্রেশনেও চিঠি দেন যেন তার সন্তানকে নিয়ে তার প্রাক্তন দেশত্যাগ করতে না পারেন।
বলাবাহুল্য কোন ফায়দাই হয়নি।
তার প্রাক্তন স্বামী কে জানে কোন খেলা খেলেছিলেন, পুলিশই বা সেই খেলায় কী ভূমিকা নিয়েছিল কে জানে। তাই তো জুনের ২৫ তারিখে বাচ্চা নিয়ে নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারলেন তার প্রাক্তন, তার সন্তানের পিতা।
নাঈমাও বুঝে গেলেন, তার প্রিয়তম সন্তানের মুখ তিনি আর কোনদিনই দেখতে পারবেন না।
আর সেই ঘটনার পরপরই অসুস্থ হয়ে হসপিটালে গেলেন নাঈমা। স্ট্রোক করেছিল তার। ফেরার আশা নাকি ছিলোই না। ফিরেননি তিনি।
নাঈমা অপরাধ একটা নয় অনেকগুলোই করেছিলেন বটে। একে নারী, তায় ডিভোর্স হয়েছে এর উপরে পিতাকে বাদ দিয়ে বাচ্চার অভিভাবকত্ব চেয়েছেন। এর চেয়ে বেশি ধৃষ্টতা কোন নারীর জন্য আর কী হতে পারে!
তাই হয়তো আইন, পুলিশ কারোরই সাহায্য তিনি পেলেন না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নুন্যতম অধিকারও তিনি আদায় করতে পারেননি আইন ও তার বাহিনীর কাছ থেকে।
অবশেষে রাষ্ট্র, তার আইন আদালত পুলিশ এবং সমাজ ও সমাজের ক্ষমতাবান মানুষসহ তার প্রাক্তনকে নিস্কৃতি দিয়ে তিনি চলে গেলেন চিরতরে।
এরকম ঘটনা অনেক আছে যেখানে বিয়ে ভেঙে যাবার পর মা সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে আইনি লড়াইয়ে গেলে কারোরই সহযোগিতা পান না।
বাচ্চার বাবা বাচ্চা নিয়ে দেশ ছাড়তে পারলেও, মা পারেন না। এমনকি মা সন্তানের অভিভাবকত্ব পেলেও সন্তান মায়ের সাথে দেশ ত্যাগের অনুমতি পায় না। সেই সিঙ্গেল মা যদি উচ্চ শিক্ষা কিংবা ভালো কোন জব পেয়ে বিদেশে যেতে চান, তিনি সাথে করে নিজের প্রিয়তম সন্তানকে নিতে পারেন না। এক অসহ্য টানাপোড়েনের মধ্যে দেশে স্বজনের কাছে সন্তান রেখে তাকে দেশ ছাড়তে হয়। নিজের বিধ্বস্ত জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়া, উন্নত দেশে নিজেকে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বারবার হোঁচট খায় সমাজের কথার জ্বালা, আইনের প্যাঁচ আর সন্তানের ভবিষ্যত কী হবে এই উৎকণ্ঠায়। অথচ ক্ষমতার ঔদ্ধত্য থাকলে আদালতে নিস্পত্তির অপেক্ষায় থাকা বিষয়কে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে বাবা দিব্যি সন্তান নিয়ে পালিয়ে চলে যায়। যা আমরা দেখলাম নাঈমা নার্গিসের ঘটনায়।
সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে একজন নারীকে, একটি মাকে যতটা কষ্ট করতে হয় নিজেকে সৎ, চরিত্রবান প্রমাণ করতে হয় ততটা একজন বাবাকে করতে হয় না। কারণ পিতৃপরিচয়ই এখনো আমাদের আসল পরিচয়। জিম্মা যে কেউ নিতে পারলেও আইনের চোখে পিতাই এখনও প্রকৃত অভিভাবক।
গর্ভে ধারণ করা, গর্ভযন্ত্রণা সয়ে সন্তানকে দুনিয়ার আলোবাতাসে আনা এসব তো স্বাভাবিক ঘটনা। বরং পিতার পরিচয় না থাকলে সে মানুষই নয়। এটাই নিয়ম। আর এই নিয়ম বানিয়েছে রাষ্ট্র, সমাজ আর আমাদের আইন।
মা বাচ্চার কাস্টডি পেলেও একটা নির্দিষ্ট সময় পর সন্তানকে বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে হয়।
আইনের ব্যাখ্যা বলছে, নাবালক শিশু, এমনকি সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে জিম্মার আবেদন জানালে আদালত সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সন্তানের জিম্মা মাকে দিতে পারেন। অভিভাবকত্ব এবং নাবালক সন্তানের জিম্মাদারিত্বের জন্য পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আইনি সমাধান পাওয়া যায়। এ ছাড়া আদালতের বাইরে উভয় পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে বা কারো মধ্যস্থতায়ও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়। আদালতের মাধ্যমে প্রতিপালনের বিষয়ে কোনো আদেশ দেয়া হয়ে থাকলে যদি কেউ আদালতের এখতিয়ারের সীমা থেকে নাবালককে সরিয়ে নেয়, তাহলে আদালতের আদেশে ওই ব্যক্তি অনূর্ধ্ব এক হাজার টাকার জরিমানা অথবা ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি কারাবাস ভোগ করতে বাধ্য থাকবে। সেখানে আদালত ও পুলিশের মাঝখান থেকে নাঈমার সন্তানকে নিয়ে তার বাবা চুপিসারে দেশত্যাগ করে কীভাবে? আর সেজন্য নাঈমার অকাল প্রয়াণ হলে তার দায় পুলিশের নয় কেন!!
এই গাফিলতিকে আমরা কী বলবো?
এটি কি নারীকে হেয় করে দেখার সেই চিরচেনা পুরুষতান্ত্রিক অস্ত্র নয়? বহুবছর ধরে চলে আসা নারী নিপীড়নের চেনা চিত্র নয়? এটি অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রদর্শন যাতে সম্পূর্ণভাবে জড়িত হয়েছে রাষ্ট্র আর তার আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
এমন মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু প্রশ্ন তো আমরা করতেই পারি।
রাষ্ট্র ও আইন নারীর প্রতি সহমর্মি আর কবে হবে? নারী আইনের কাছে কতটা সহযোগিতা পায় যদি ক্ষমতাবান কেউ তার পেছনে না থাকে? নাঈমা নার্গিস এই রাষ্ট্রের নাগরিক, তার জীবন কি রাষ্ট্রের কাছে মূল্যহীন? আদালত কি পুলিশের কাজে গাফিলতির জন্য জবাবদিহিতা চাইবে?
এইসব প্রশ্নের জবাব হয়ত কখনোই পাওয়া যাবে না। কারণ আমরা নারীরা সবসময়ই জানি, বাংলাদেশ কখনই নারীবান্ধব রাষ্ট্র নয়, ছিলো না কখনো। এই সমস্ত ঘটনাগুলো ঘটলে তা আরো বেশি করে বুঝতে পারি।