রোকসানা বিন্তী:
বাবা দিবসে বাবাদের নিয়ে সবাই খুব ভালো ভালো কথা বলেছে! কিন্তু আমি বলছি একটু অন্যরকম কথা!
বাবাদের নিঃসঙ্গতার কথা, যার জন্য সত্যিকার অর্থে দায়ী বাবারাই!
যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষিত ধরি, বাবা হওয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান পালনের বাকি সময়টাতে কয়টা বাবা মাকে যতটা সম্ভব তার পুরোটা দিয়ে সাপোর্ট করেন?
ফেসবুকের শিশুপালন বিষয়ক গ্রুপগুলোর পোস্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সন্তান পালনের ক্ষেত্রে মায়েরা যেই সমস্যাগুলো প্রতিনিয়ত ফেস করছেন, তার অন্যতম একটি হলো- সন্তানের বাবা সাপোর্টিভ নন!
অর্থাৎ শিশু দেখাশোনার পুরো দায়িত্বটা মায়ের একার ঘাড়ে! বাবা তেমনভাবে সাহায্য করেন না!
সন্তানপালন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া! এক-দুই দিনের বা চার-পাঁচ বছরের ব্যাপার নয়! বিশেষ করে বাচ্চা যখন ছোট থাকে তখন তাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, পড়াশোনা শেখানোসহ অন্যান্য সব কাজই অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- এই দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ কর্মকাণ্ডে বাবাদের অংশগ্রহণের হার খুবই কম!
বাচ্চা যখন ছোট তখন ঘুমের ব্যঘাত হয় এই অজুহাত দিয়ে বাবা পাশের রুমে আরামে ঘুমিয়ে থাকেন যেখানে মা হয়তো সারাদিন-সারারাত পাঁচ মিনিটের জন্যও ঘুমাতে পারেননি! এটা এমন একটা বাস্তব ঘটনা যার মুখোমুখি হতে হয়েছে বহু মাকে! বাচ্চা একটু বড় হলে সে কোয়ালিটি টাইম চায়! সে খেলতে চায়!
প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখতে চায়!
কিন্তু বাচ্চার বাবা বাচ্চাকে সময় দেয়ার চাইতে হয়তো নিজেকে সময় দিতেই বেশি আগ্রহী থাকেন! টিভি, মোবাইল বা অন্য কিছু নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন! ফলে বাচ্চা তার বাবাকে দিনের যতটা সময় পাওয়ার কথা ততটা পায় না! শিশুরা খুব দ্রুত সবকিছুর সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায় ফলে এই বিষয়টাও একটা বাচ্চা স্বাভাবিকই ধরে নেয়! সে যখন দেখতে পায় তার সব কথা, সব সমস্যা, সব খেলার সঙ্গী হচ্ছে তার মা, তখন সে পুরোপুরি মায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে যায়! মা কে তখন সে একমুহূর্তের জন্যও কাছছাড়া হতে দেয় না যার প্রেক্ষিতে বাবা আরও হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন!
এভাবে মা বাচ্চার বড় হওয়ার সাথে, বাচ্চার আবেগ অনুভূতির সাথে যতটা সমন্বয় রাখতে পারেন, বাবা ঠিক ততটা পারেন না! কারণ বাচ্চার আবেগ বুঝতে হলে বাচ্চাকে যতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন, তিনি ততটা সময় বাচ্চাকে দেন না!
এরই মাঝে বাচ্চা বড় হতে থাকে!
শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখে!
অন্যদিকে বাবারও বয়স বাড়তে থাকে!
একসময় যে কাজগুলো করতে বাবার ভালো লাগতো সেগুলো আস্তে আস্তে অর্থহীন মনে হতে থাকে! তার চাইতে পরিবারের সঙ্গ পেতে আগ্রহ বাড়তে থাকে! সন্তানদের সাথে গল্প-গুজব করতে ইচ্ছে হয়! কিন্তু বাবা লক্ষ্য করেন- সন্তানরা তাকে বেশি সময় দিতে আগ্রহী নয় বরং মায়ের সাথে কথা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে!
বাচ্চা একসময় খেলার জন্য বল নিয়ে বাবার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো কিন্তু বাবা সময় দিতেন না আর পরবর্তীতে বাবা একটু কথা বলার জন্য সন্তানের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকেন! সন্তান হয়তো দায়িত্বটুকু পালন করে কিন্তু হৃদয়ের কাছাকাছি তারা কেউই আর হতে পারেন না!
এই পর্যায়ে বাবা নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকেন!
তিনি একাকীত্বের যন্ত্রণা টের পান!
তিনি বুঝতে পারেন সন্তান তার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে, কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই!
কারণ যখন করার ছিল তখন ব্যস্ততার দোহাই, ক্লান্তির দোহাই দিয়ে তিনি তা করেননি!
দুই বছরের বাচ্চার আবেগ বোঝা যতটা সহজ, আঠারো বছরের তরুণের চিন্তা বোঝা ততটাই কঠিন! দুই বছরের সময় বাচ্চাকে চাহিদামতো সময় দেওয়া হয়নি, এখন চাইলেও আঠারো বছরের তরুনের সময় পাওয়া যাবে না!
এটাই বাস্তব!
কোন সম্পর্কই শতভাগ স্বার্থহীন না!
সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় হয়ে দেখা দিবেই!
অথচ এই সহজ কথাটা বুঝতে বাবারা এতোটা দেরি করে ফেলেন যে পরবর্তীতে আর সন্তানের কাছে ফিরে আসতে পারেন না!
দূরত্ব দিনে দিনে বাড়তেই থাকে!
বাহ্যিকভাবে হয়তো কাছাকাছি থাকেন, কিন্তু সন্তানের মনের কাছাকাছি আর যেতে পারেন না!
জীবনটা এক পর্যায়ে অর্থহীন মনে হতে থাকে!
বাবাদের জীবনটা শেষ হয় অসীম নিঃসঙ্গতা আর হতাশার মধ্য দিয়ে…।
রোকসানা বিন্তী