হায়, সন্তান না জন্মালে জীবনই ব্যর্থ!

শান্তা মারিয়া:

কয়েকদিন ধরেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে। কিন্তু কাজের চাপে লেখার সময় করে উঠতে পারছি না। তবে মা দিবসে ফেসবুক জুড়ে মায়েদের ছবি দেখে আর মায়েদের স্ট্যাটাস পড়ে পড়ে আর না লিখেও পারছি না।

মা অবশ্যই সম্মানের। মাতৃত্ব অনেক বড় বিষয়। সন্তানের জন্য মায়ের অনেক আত্মত্যাগ থাকে। মাকে সন্তান অনেক ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, সবই ঠিক। আমার নিজেরও সন্তান আছে। বেশ ভালো ও উপযুক্ত সন্তান। তাকে অবশ্যই আমি অনেক ভালোবাসি। এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও ভালোবাসি। আমার সন্তানও আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে ও সম্মান করে। কিন্তু তারপরও বলছি, ধরুন একজন নারীর সন্তান নেই, বা আমারই যদি সন্তান না থাকতো, তাহলে কি আমার জীবন ধারণই বৃথা হয়ে যেত?

আরেকটি প্রশ্ন, কেবলমাত্র বায়োলজিক্যালি একটি শিশুকে জন্মদানের মাধ্যমেই কেবল মা হওয়া সম্ভব?

আমার মনে পড়ছে বিখ্যাত রুশ লেখক ভেরা পানোভার ‘মা’ উপন্যাসটির কথা। অনেকেই হয়তো বইটি পড়েছেন। যারা পড়েননি তাদের জন্য সংক্ষেপে কাহিনিটি বলছি। একজন নারী তার প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্কের পর গর্ভধারণ করেন। পরে প্রেমিকের চাপে অ্যাবোরশন করতে বাধ্য হন। অদক্ষ পদ্ধতিতে অ্যাবোরশনের কারণে তিনি সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারান। প্রেমিকটিও কেটে পড়ে। একজন যুবকের সঙ্গে তরুণীর বিয়ে হয়। তারা বেশ সুখী দম্পতি হন। কিন্তু সন্তান লাভ করতে পারেন না। পরে বিভিন্ন ঘটনায় কয়েকজন অসহায় শিশুকে আশ্রয় দেন এই দম্পতি। শিশুদের মা বাবা হয়ে ওঠেন তারা। এই নারী বায়োলজিক্যালি শিশুর জন্মদান না করেও অনেকগুলো অসাধারণ সুসন্তান লাভ করেন।

আরেকটি রুশ গল্প মনে পড়ছে। গল্পটির নাম, শহরের মেয়ে। লেখক লুব্যোভ ভরোঙ্কভা। গল্পটি হলো, ভালেন্তিনা নামে এক আট বছরের মেয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার বাবা মাকে হারায়। সে আশ্রয় পায় গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। সেখানে কৃষক নারী তার তিনটি সন্তানের পাশাপাশি এই মেয়েটিকেও সন্তানস্নেহে লালন করেন। মেয়েটির কাছে কীভাবে তিনি ‘মা’ হয়ে উঠলেন তার অসামান্য কাহিনী ‘শহরের মেয়ে।’

আরেকটি ঘটনা। মস্কো চিড়িয়াখানার পরিচালক ভেরা চাপলিনা একটি সিংহছানাকে লালন পালন করেন তার ফ্ল্যাটে। সিংহ ছানাটির নাম কিনুলি। একসময় কিনুলি হয়ে ওঠে ভেরা চাপলিনার সন্তান। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পরও সিংহী কিনুলি তার সহজাত হিংস্রতা ভুলে মানুষ মাকে আঁকড়ে থাকে পরম মমতায়।

আমার নিজের কাছে মনে হয় মাতৃত্ব অবশ্যেই অনেক বড় বিষয়। মাতৃত্ব মানে হলো স্নেহ, মমতা, দায়িত্ববোধ, কল্যাণকর ভূমিকা। এর জন্য বায়োলজিক্যালি মা অথবা বাবা হওয়াটা জরুরি নয়। যিনি বা যারা মানবতার কল্যাণ করেন তিনিই মা অথবা বাবা। যিনি একটি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যিনি সৃজনশীল কোন কাজ করেন, যিনি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করেন, যিনি সাহিত্য বা বিজ্ঞান বা শিল্পকলার জগতে নিমগ্ন থাকেন, তারা প্রত্যেকেই মা এবং বাবা।

শুধু তাই নয়। যিনি কর্মময় জীবন যাপন করেন তিনিই মা এবং বাবা। একজন পুরুষও মা হতে পারেন, একজন নারীও বাবা হতে পারেন। হতে পারেন একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও। যিনি দেশের, সমাজের, রাষ্ট্রের, বিশ্বের জন্য কাজ করেন তিনি বায়োলজিক্যালি সন্তান জন্ম দিয়েছেন কিনা সেটা কোন বিষয়ই নয়। তিনি অবশ্যই মা এবং বাবা। আবার বায়োলজিক্যালি সন্তান জন্ম দিয়েও তো অনেকে বাবা, মা হতে পারেন না। প্রায়শই তো শোনা যায় কোন বাবা অথবা মা তার সন্তানকে পরিত্যাগ করেছে, হত্যা করেছে, অবহেলা করেছে, অপরাধের দিকে ঠেলে দিয়েছে, মানসিকভাবে তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে কিংবা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে। এরা কি বাবা-মা? এরা কি মা-বাবার মতো সম্মানসূচক অভিধায় অভিহিত হওয়ার যোগ্য? এরা স্রেফ প্রসবকারী কিংবা স্পার্ম প্রদানকারী।

নারীর শরীর অথবা তার জীবন শুধুমাত্র সন্তান ধারণের কাজে ব্যবহৃত হবে এটা অতি ফালতু চিন্তা। নারীর জন্ম শুধু বায়োলজিকালি মা হওয়ার জন্য, পুরুষের জন্ম শুধু বায়োলজিকালি বাবা হওয়ার জন্য সেটাই বা কেমন কথা। আগের দিনে রূপকথায় পড়তাম, রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া ধনদৌলত সব আছে। শুধু সন্তান নেই বলে তার হাহাকার। সাত রানীও তাকে সন্তান দিতে পারছে না। তাই তিনি অবশেষে একজন নতুন রানী নিয়ে আসেন অথবা সন্ন্যাসীর বরে সন্তান পান। আমার ধারণা ছিল এই ধরনের ফেইরি টেলসের সময় থেকে আমরা অনেকটা এগিয়ে গেছি। কিন্তু এবার বেশ কিছু স্ট্যাটাস দেখে আমার মনে হয়েছে ‘সন্তান জন্মদানই নারী জীবনের সার্থকতা’ কিংবা ‘সন্তান জন্মদানের পর আমার জীবন পূর্ণতা পেয়েছে’ এসব চিন্তা এখনও অনেকেই ধারণ করেন।

নারী কি কেবল গর্ভাশয় আর পুরুষ কেবল স্পার্ম উৎপাদক? তারা কি মানুষ নয়?
পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যখন অনেক কম ছিল তখন সন্তান উৎপাদনই মানবের প্রধান কাজ বলে গণ্য হতো বটে। কিন্তু একুশ শতকে বিশ্বে মানব প্রজাতির জীবের কোন কমতি নেই। বরং বাড়তি আছে।
আরেকটি কথা প্রায়ই শুনি। অনেকেই কোন নিঃসন্তান নারী পুরুষকে দেখলেই মন্তব্য করেন ‘আহারে আপনার ছেলে মেয়ে নাই? উত্তরাধিকার তো কেউ নাই, আপনার টাকা খাবে কে?’

ভাব দেখে মনে হয় উনাদের ধারণা ওই দম্পতির যেন ময়ুর সিংহাসন বা রোমান সাম্রাজ্য রয়েছে যেটা সন্তানের অভাবে বেহাত হতে পারে।
একজন মানুষের জীবন তার নিজেরই। সন্তানের জন্য বা অন্য কারো জন্য নয়। আমি এখানে তিনজন নারীর কথা বলবো। তারা প্রত্যেকেই আমাদের সমাজের। একজন নারী একটি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনি অসংখ্য মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তুলেছেন। তিনি বিবাহিত। সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করছেন। তার সন্তান হয়নি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় তিনি এই সমাজকে নারীর জন্য নিরাপদ করে তোলার পথে যে সংগ্রাম করছেন তাতে তিনি অনেক বড় একজন ‘মা’।

আরেকজন নারী একটি বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। দেশের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করছেন। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। সন্তান ধারণের জন্য তিনি অনেক চিকিৎসাও করেছেন। সেসব চিকিৎসা তার শরীরকে অনেক ক্ষতিগ্রস্তও করেছে। দু’তিনবার তার গর্ভপাত হয়ে গেছে শত সাবধানতা সত্ত্বেও। তার পেশাগত সাফল্যে যারা ঈর্ষান্বিত তারা আর কোনকিছুতে না পেরে তার সন্তানহীনতা নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা বলে আরাম পান। আমার কাছে মনে হয়, এতগুলো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যিনি করেছেন তিনি অবশ্যই রত্নগর্ভা মা।

শেষ করবো আরেকজন নারীর কথা দিয়ে। তিনি অবিবাহিত ও নিঃসন্তান। একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান করেছেন। পাশাপাশি অনেকজন দরিদ্র শিশুর দৈনিক আহার এবং লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন। আমার তো মনে হয় তিনি এই অসহায় শিশুদের মা।

আমার কাছে মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব মানে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, মানবিক হওয়া, কর্মময় হওয়া, দায়িত্বশীল হওয়া। আর বয়োলজিকালি মা না হতে পারলে নারীর জীবন ব্যর্থ বা অসম্পূর্ণ- এই বস্তাপচা চিন্তাটাকে আমি প্রত্যাখ্যান করছি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.