কোন মা-ই শতভাগ নিখুঁত নয়

রিমি রুম্মান:

এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা নিউইয়র্কের একটি স্বনামধন্য পত্রিকার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে। কুশল বিনিময় হয়। সেই যে চাকুরি ছেড়ে এলাম, তারপর আর কোথাও যোগ দিয়েছি কিনা, আমাদের সন্তানরা কত বড় হলো, কে কী করছে, পড়ছে এইসব। উনার ছেলেরা ভালো চাকুরি করছে। করারই কথা। আজ থেকে বিশ বছর আগে আমরা যখন সহকর্মী ছিলাম, তখন উনার ছেলে একটি নামকরা বিশেষায়িত স্কুলে পড়ছিল। আর এ কারণেই কর্মক্ষেত্রে আমরা তাকে সমীহ করতাম। সম্মানের চোখে দেখতাম। অবশ্যই তিনি একজন ভালো মা। সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ও যত্নশীল না হলে তারা স্কুলে আশানুরূপ ফলাফল করা কিংবা ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবার কথা নয়।
জেনে যারপরনাই আনন্দিত হই যে, সেদিনের ছোট্ট পুত্রদ্বয় আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কেউ বিয়ে-শাদী করেনি। আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। একজন ম্যানহাটনে, অন্যজন অন্য শহরে। তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন,’আমার ঘর খালি পড়ে আছে। শুধু আমরা স্বামী-স্ত্রী’। সন্তান বড় হবে, নিজের মতো করে আলাদা থাকবে, এতো আজকাল স্বাভাবিক বিষয়। দুঃখ পাবার কিছু নেই। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের হোস্টেলে চলে যেতে হয়। তখনই সন্তানের সঙ্গে শারীরিক দূরত্বের শোকে কিংবা চোখের সামনে দেখতে না পাবার হাহাকারে মায়েরা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

আমার এক বন্ধুকন্যা হোস্টেলে চলে যাবার পর আমাকে অনুভূতি প্রকাশ করেছিল এইভাবে, ‘মনে হচ্ছে কেউ আমার শরীর থেকে চামড়া খুবলে খুবলে নিয়ে গেছে।’ আরেকজন বলেছিল, ‘মনে হচ্ছে আমার শরীর থেকে কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে কেউ। এটাকে কি বেঁচে থাকা বলে?’ কিন্তু সব কষ্টই তো এক সময় সয়ে আসে। পড়াশেষে প্রতিষ্ঠিত হবার পর সন্তান আলাদা বাসায় থাকাটাও মায়েদের সয়ে যাওয়ার কথা।
কথা প্রসঙ্গে জানলাম, ছেলেরা সেই অর্থে বাবামায়ের খোঁজ রাখে না। বলা চলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। যেন শেকড় উপড়ে ফেলার মতো অনুভূতি। হলরুমের প্রচণ্ড হৈচৈ আর মাইকের উচ্চ শব্দের মাঝেও চেয়ার টেনে কাছে এসে বসলেন। সন্ধ্যার তরল অন্ধকারের মতো গম্ভীর মুখ। একটু থেমে বিমর্ষতায় ভরা স্বরে বললেন, ‘যখন ছোট ছিল, ওদের তো সেই অর্থে সময় দিতে পারিনি। কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি। ছুটির দিনে হয় ওদের বাবার কাজ থাকতো, নয়তো আমার। পরীক্ষায় ভালো নাম্বার না পেলে রাগ করেছি, শাসিয়েছি। ওরা ভয় পেয়েছে। পরীক্ষায় ভালো করেছে বরাবর।’

আবারও বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘদিন পর দেখা হলেও আমরা আর নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করতে পারিনি। প্রশস্ত সড়কের উপর পা ফেলে হেঁটে গেলেই যেমন কেউ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে না, তেমনি ভালো ফলাফল করা, নামকরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়া মানেই সব পেয়ে যাওয়া নয়। সন্তানের সঙ্গে বন্ধন মজবুত না থাকলে সকল পরিশ্রমই যে বৃথা! আচমকা মনটা বিষাদে ভরে গেল। মানুষের বিষণ্ণ মুখের ছায়া নিকটজনকেও বিমর্ষ করে তোলে।

এইদিকে আমাকে মঞ্চে যাবার জন্যে, কিছু বলার জন্যে এনাউন্স করছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গেলাম। ভেতরে একবুক বিষণ্ণতা চেপে রেখে হ্যান্ডমাইক হাতে তুলে নেই। নির্ভুল সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটির সাহসী অভিযাত্রা অব্যাহত থাকুক, এই প্রত্যাশা জানিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসি। কিন্তু আমার ভেতরে এক অজানা আশঙ্কা তোলপাড় করে চলছিল। করোনা পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন পর লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করছিলাম যদিও। এই প্রথম স্পষ্ট উপলব্ধি করি, একজন মানুষ কেমন করে একই সঙ্গে দ্বৈতসত্তার ভেতরে বসবাস করে!

কোলাহলের মাঝেও আঁধারঘেরা মূর্তির মতো ড্রিঙ্কস বারের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। বিশ বছর পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করি।

তখনও আমি মা হইনি। তিনি টিনএজ দুই সন্তানের জননী। কর্মস্থলে আমাদের রুটিন ছিল দুপুর একটা থেকে রাত দশটা। বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা নয়তো বারোটা। রোজ স্কুল থেকে ফিরে সন্তানরা মাকে পায়নি। মা বাড়ি ফিরেছে সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়ার পর। আমার মনে আছে, তিনি ছেলেদের জন্যে দুপুর এবং রাতের খাবার তৈরি করে টেবিলে ঢেকে রেখে কাজে আসতেন। ব্রেক টাইমে কিংবা সুযোগ পেলেই লুকিয়ে একাধিকবার ফোনে খবর নিতেন। একজন মা হিসেবে দায়িত্ব পালনে কমতি করেননি। যেহেতু আমি নিজেই বর্তমানে দুজন টিনএজ সন্তানের মা, তাই অজানা আশঙ্কায় পেয়ে বসে। অবচেতন মনে পেছনের কালে ফিরে যাই। আমি কি আমাদের সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিয়েছি? ছুটির দিনে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি? তাদের শৈশব, কৈশোর আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করেছি? মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখেছি? আমার চোখের সামনে ডানা ঝাপটে ওড়াওড়ি করে ফেলে আসা প্রতিটি দিন। মা হবার ঠিক দুইমাস আগে সেই যে চাকুরি ছেড়েছি, গত উনিশটি বছর আর কোনো চাকুরিতে যোগ দেইনি। পড়াশোনা শেষ করিনি, কাজে ফিরিনি, ক্যারিয়ার গড়িনি। শুধুই একান্ত মনোযোগী মা। প্রতিটি মুহূর্ত সন্তানদের সঙ্গে থেকেছি। যতক্ষণ সন্তান জেগে থেকেছে, সব কাজ ফেলে তার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে একাকি কথা বলেছি। যখন ঘুমিয়েছে, আমি আমার সাংসারিক কাজ সেরেছি। সন্তান একটু বড় হলে মায়েরা স্বপ্ন দেখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার বানানোর। আমি শুধু স্বপ্ন দেখেছি আমার সন্তান আর দশটা শিশুর মতো কথা বলুক। খেলুক। শুধুই একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো বেঁচে থাকুক।

যখন স্কুলে ভর্তি হলো, সে স্কুলে থাকাকালীন কাছের লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। শিশুদের উপযোগী বইগুলোর প্রতিটি পাতা উল্টে পড়েছি। আকর্ষণীয় এবং আনন্দদায়ক বই বাছাই করে নিয়ে এসেছি। মনে মনে প্রশ্ন তৈরি করেছি। প্রতিটি অক্ষর, শব্দের উপর আঙুল রেখে তাকে পড়তে দিয়েছি। বইটি সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি। একটু বড় হলে নানান রকম পড়া তৈরি করেছি। একটি লাইব্রেরি কার্ড দিয়ে দিনে ২০টি পেইজ ফ্রি প্রিন্ট কারা যায়, আমি সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছি। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ, ভোকাবুলারি প্রিন্ট করে নিয়ে এসেছি। খেলার ছলে পড়িয়েছি। আরেকটু বড় হলে বিগত বছরের স্টেট টেস্টের প্রশ্নপত্র এনে প্র্যাকটিস করিয়েছি।

এইসব করতে গিয়ে আমি কি তার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছি? পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করার চেষ্টা করি। না, আমি তার সঙ্গে বসে কার্টুন দেখেছি, হা হা হো হো শব্দে হেসে কুটি কুটি হয়েছি, ব্লক খেলেছি, কোমর দুলিয়ে নেচেছি। সবকিছুই ছিল তার দৈনন্দিন জীবনাচরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমি মনে করার চেষ্টা করি, কোথাও কি কোনো ভুল করেছি? ছুটির দিনগুলোয় সন্তানদের বেড়াতে নিয়ে যেতে কার্পণ্য করেছি? ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে উঠলো, আমাদের পাহাড়, সমুদ্র, আর অরণ্যে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলো। একাকী নয়, বন্ধুবান্ধবের বিশাল বহর নিয়ে। কেননা বন্ধুদের সন্তানরা আমাদের সন্তানদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দূরদূরান্তের হোটেলে রাত্রিযাপন করেছি। আমরা একটি বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের মতো একে অপরের সান্নিধ্যে ছুটির দিনগুলো কাটিয়েছি প্রতি গ্রীষ্মে। সন্তানরা দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে বল নিয়ে ছুটোছুটি খেলেছে। সুইমিং পুলের নীল জলে হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতার কেটেছে। খাবার টেবিলে পায়ে পা ঠুকিয়ে খুনসুটি করেছে। হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়েছে।

আমার যেহেতু সেই অর্থে কোনো চাহিদা ছিল না, তাই অর্থ উপার্জন ও ব্যয় করা নিয়েও কোনো আক্ষেপ ছিল না। দামি শাড়ি কিনিনি। মেকআপ, জুতা কিংবা ব্র্যান্ডনেইম ব্যাগও না। চাহিদা যা ছিল, তা কেবলই আমার সন্তানদের পরিপূর্ণ সময় দেয়া। তাদের বেড়ে ওঠা সময়ের একটি মুহূর্তও অপচয় করতে চাইনি। তারা যেন আশৈশব ঘরটিকে মনে রাখে। বাবা-মা’র কথা স্মরণ রেখে মুহ্যমান হয়। প্রতিটি মুহূর্ত আমি তাদের বন্ধু হতে চেয়েছি। শারীরিক ও মানসিকভাবে কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি। এর পেছনে বিশাল এক বটবৃক্ষ হয়ে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের বাবা। যেখানে আমার সীমাবদ্ধতা ছিল, সেখানে সে এগিয়ে এসেছে।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, একজন মায়ের ক্ষমতা অসীম, এবং তা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। তবে কি আমি সন্তানদের বিষয়ে চিন্তামুক্ত? না, একজন মা কখনোই সন্তানদের বিষয়ে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতে পারেন না। সন্তান প্রতিপালনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো মা-ই শতভাগ নিখুঁত নয়। আর তাই মৃত্যুর আগ অব্দি এক অজানা অশুভ ভয় তাড়া করে ফেরে। সন্তানের মঙ্গল কামানায় স্রষ্টার কাছে আকুতি জানায়। বড় হয়ে সন্তান খোঁজ রাখুক বা না রাখুক।

আকাশে-বাতাসে উচ্চারিত হোক পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম শব্দ ‘মা’। সকলকে মা দিবসের আগাম শুভেচ্ছা।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.