আনন্দময়ী মজুমদার:
সারাটা জীবন কারো কারো কাটে এক একটা গাঢ় অনুভূতির ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে। যেমন রঙের বিস্তারে ছবির গাঢ়তা আসে, যে শিল্পীর অনুভূতি যেমন তেমন করে প্যালেটে তারা রং মাখায়, তেমন করেই আমরা অনুভব করি বিভিন্নভাবে। তবে আমাদের অনুভূতির মৌলিক রংগুলি হয়ত এক। আমরা সকলেই আনন্দ চাই, স্বাস্থ্য চাই, সুযোগ চাই, নিজের মতো শান্তিতে বাঁচতে চাই, স্বীকৃতি চাই, কৃতজ্ঞতা চাই, নিরাপত্তা চাই, নিজের স্বজনদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা চাই;সুখী, স্বচ্ছন্দ, নিজের মতামতকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হচ্ছে এমন কমিউনিকেশন চাই। আমাদের যদি কোনো বিশেষ প্রতিভা বা শখ থাকে তা পালন করে যাবার সাপোর্ট-সিস্টেম চাই, সঙ্গী চাই। এমন কেউ নেই যে এগুলো নিজের জন্য চাই না।
সকলের উঠে আসার প্রেক্ষিত তো আলাদা। কেউ কারো মতো নয়, হুবহু। আবার মৌলিক মিল আছে, সেটা তো অস্বীকার করতে পারছি না।
আমরা অনেকেই ঘরের কথা, পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা, ভাইবোনের কথা, জীবনসঙ্গী অথবা সন্তানের কথাটা না ভেবে পারি না। সেখানে আমরা সকলেই বেশ সাধারণ, সকলেই বেশ এক রকম।
স্বাস্থ্যের ব্যাপারটাও হয়ত এক একজনের কাছে এক এক রকম। যদিও মৌলিকভাবে খুব বেশি আলাদা মনে হয় না। কারো অসুখ হয়েছে। অসুখটা মনের না দেহের? বলা কঠিন। কারণ মন আর দেহ তো অঙ্গাঙ্গি জড়ানো। এখন বেশির ভাগ অসুখ যেমন মাইগ্রেন, ডায়াবিটিস, থাইরয়েড, ক্যান্সার এমনকি চর্মরোগ বা অন্যান্য অনেক কিছুই মনে করা হয়, মনের স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত। ১০০ ভাগ স্বাস্থ্যবান কেউ নয় বলেই, স্বাস্থ্যচর্চা একটা নিয়মিত ব্যাপার। কিন্তু স্বাস্থ্যচর্চা আসলে কী? কতগুলো অভ্যেস? স্বাস্থ্য চর্চা করলে কী হয়? প্রথমত আমার নিজের শরীরে থাকতে ভালো বোধ হয়। খুশি খুশি লাগে। পৃথিবীটা কে একটু আপন মনে হয়। সবাইকে ভালো লাগে। প্যান্ডেমিক আমাদের স্বাস্থ্যসচেতন করে তুলেছিল কিছুটা। আমরা আমাদের সুস্থ থাকা যে কতটা গুরুত্বের তা বুঝতে পেরেছিলাম। দেহের ভালো থাকার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই মানসিকভাবে ভালো থাকা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল।
আমার কাছে স্বাস্থ্য কথাটা নিয়ে ভাবতে হয়েছে তেরো বছর বয়েসে। বয়োসন্ধি কালে। অনেকের হয়। যেমন আমার একটা মহাদেশ পাল্টে আসার ঘটনা ঘটেছিলো সাড়ে দশ বছর বয়েসে। আফ্রিকা থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর অনেক cultural বিষয় আমাকে নতুন করে শিখতে হয়েছে। শরীর কাজগুলো করে গেছে, কিন্তু হৃদয়ের পক্ষে ‘এডজাস্ট’ করতে সময় লেগেছে। তারই ফলস্বরূপ হয়ত তেরো বছর বয়েসে এসেছিল একটা মরণ ব্যাধি – এনরেক্সিয়া। এটা একটা খাদ্য অভ্যাসের সমস্যা। কিন্তু একটি সংবেদনশীল ও বিশেষভাবে সচেতন পরিমণ্ডলের অভাবে এই অসুখের জন্য যে ট্রিটমেন্ট লাগত, যার মধ্যে প্রথমটা ছিল গভীর সমবেদনা, শ্রদ্ধা আর আস্থা, আর বিজ্ঞানমনস্ক নিউট্রিশন নিয়ে ভালো ভালো বই — তেমনটা আমার মেলেনি। সমাজ এই অসুখের জন্য আমাকে একটু জাজমেন্ট দিয়ে — একটু শক্ত চোখে বা বাঁকা চোখে দেখেছে। আসলে এটা কারো দোষ নয়। সব কিছুর মূলেই স্বাস্থ্য — কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো সব সময় সঠিক বা গভীর জানাশোনার ওপর দাঁড়িয়ে নেই। আমরা শোনা কথায় বেশি কান দিই। কিন্তু নিউট্রিশন নিয়ে বা স্বাস্থ্য নিয়ে এক্সপার্টদের বইপত্র পড়ি না। যদিও তেমন কোর্স বা বইয়ের কোনো অভাব নেই। নিউট্রিশন নিয়ে আমরা পরে সিদ্দিকা কবিরের বইটি ছিল আমার প্রথম ছোটবেলার কৌতূহল মেটানোর প্রয়াস। পরে অবশ্য অনেক ভালো ভালো এক্সপার্ট পেয়েছি। ইদানিং কালে আয়ুর্বেদ নিয়ে একটু পড়ছি। তার আগে একজন ক্যান্সার যোদ্ধা ক্রিস কার (Kris Carr) এর বই পড়েছি, উদ্বুদ্ধ হয়েছি, আরো যা যা ভালো কোর্স পেয়েছি ইন্টারনেটে করার চেষ্টা করেছি।
সেই তেরো বছর বয়েসে কঠিন অসুখ, যা থেকে বেঁচে ফিরেছিলাম, না-ও ফিরতে পারতাম, তা ছিল আমার জন্য উন্মোচনের একটা দিক। এই অসুখ আমাকে শিখিয়েছিল, সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরতে কেমন লাগে। খুব ছোটো হলেও আমার মনে হয়েছিল, আমি সব কিছু নতুন চোখে দেখছি। আমার প্রথম ভালোবাসার সচেতন অনুভূতি এই বয়েসে। প্রথম কবিতাও এই চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়েসে। আসলে জীবনের প্রতি আমার এটিচিউড এবং আমার আত্মবিশ্বাসের ভিত তৈরী হয়েছিল এই সময়ে। আমার পরম সৌভাগ্য আমার সেই ইতিবাচক ফেরার সময়ে আমার সহপাঠী, বন্ধু, আত্মীয় সকলেই যেন পরম স্নেহের সঙ্গে, আদরের সঙ্গে আমাকে ফিরিয়ে নিয়েছিল। আমার স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকরা যেন আমার কতো আপনজন হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ আমার ভালো থাকার মূল কথাটা ছিল — আমি সকলকে ভালবাসতে পারলাম, যেহেতু আমি নিজেকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছিলাম।
এই নতুন করে নিজেকে ভালোবাসার অনুভূতি এক ধরণের মৌলিক অনুভূতি যা আমার মনে হয় সবার মধ্যে আছে। তার একটা দিক হলো সব কিছুকে সবাইকে তখন সহনীয় শুধু নয়, বেশ ভালো, এমন কি, অসাধারণ লাগে। সকলেই যেন আমার জন্য, এই পৃথিবীর আলো যেন আমার জন্য প্রতিদিন ফুটছে, সব কিছু যেন আরো আলোময়, আরো রূপসী হয়ে উঠছে, সাধারণ সব ঘটনাকে অসাধারণ মনে হচ্ছে। এমন অনুভূতি যেন স্বর্গীয়। আর সেই অনুভূতি আমরা মরতে মরতে বেঁচে উঠলে অনেক সময় পেয়ে যাই। আমার মতো চৌদ্দ-পনেরো বছরে মেয়েও সেই সময় পেয়েছিলো।
এমন অনুভূতি নিয়ে অনেক লেখক, গবেষক, স্বাস্থ্যকর্মী, অনেক মানুষ কাজ করেছেন। কবিরা এই নিয়ে কবিতা লিখেছেন।
নিজেকে নিজের মতন করে ফিরে পাওয়ায় পরম আনন্দময় মুহূর্তের আরেকটি হলো মা হবার অনুভূতি।
একটি সদ্যোজাত শিশুর গন্ধ শোঁকেননি এমন কি কেউ আছেন? এই গন্ধ হলো বেঁচে থাকার শ্রেষ্ঠ একটি সুঘ্রাণ।
আর প্রথম মা হবার পর একটি না-দেখা না-চেনা অলৌকিক আত্মাকে নিজেদের কোলের মধ্যে কেউ ফেলে দিয়ে বলছে, এর যত্ন নাও, সারা জীবনের জন্য এ তোমার সন্তান, ব্যাপারটা অলৌকিক না তো কী? যে আমাদের উদ্ধার করার জন্য এসেছে, প্রতি নিয়ত আমাদের ঝেড়ে মুছে জাগিয়ে সজাগ করে নিজেদের সর্বোচ্চ ভালোবাসাকে টেনে নেওয়ার জন্য এসেছে সেটাও তো আমরা অনেকেই অনুভব করেছি?
এরকম বারবার আমার মনে হয়েছে জীবনে খুব কঠিন ঘটনা (যেমন জন্ম, মৃত্যু, অসুখ, বিচ্ছেদ) আমাদের নতুন করে বেঁচে ওঠার এক একটি অধ্যায় শেখানোর জন্য আসে। আমরা বুঝতে পারি, বা না পারি। এই সব অধ্যায়ের পরে আমরা আবার নতুন করে জন্মাই। এবং যখন নিজেকে ভালোবাসি (কারো কারো জন্য নিজেকে ভালোবাসা খুব কঠিন, আমার জন্য যে মাঝেমাঝে সেটা হয় না, কেমন করে বলি?) তখন দেখি যে আমি যেন আমার নিজের ছোটবেলাটিকে হাতে ধরে নিয়ে চলেছি, নিজের শিশুর মতো। নিজেকে ভালোবাসা মানে নিজের সেই শৈশব কৈশোরের আমাকে — পরম স্নেহশীল চোখে দেখা। সেই সব শৈশবের ছবিগুলি সামনে রাখা। আমাদের ব্রেইন ভুলে গেলে কী হবে, আমাদের দেহের কোষে কোষে সেই শৈশবের সরলতা, সেই শৈশবের চাওয়া-পাওয়া এখনো ঘুরছে, কাঁদছে, স্নেহমমতা খুঁজছে!
সেই শৈশবের আমার দুঃখ-দুর্দশাকে ‘জাজ’ না করে তার সঙ্গে থাকা, তার হাতটা ধরা, তাকে সান্ত্বনা দেওয়া মনে মনে এমন কিছু কঠিন তো নয়। কাজটা আধুনিক সাইকোলজির ভাষায় বলে ‘ইনার চাইল্ড হিলিং’। এই ব্যাপারটা এখন অনেক ধরণের অসুখের নিরাময়ের মৌলিক কথা।
এবং সেই আত্ম-দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী নিজের জন্য সুখকর একটা জায়গা মনে হয়। কারণ সকলেই তো কোনো না কোনো সময় ওই সরল শিশুটি ছিল, আমাদের মতন! তার ভয়, ভাবনা, ভালোবাসা, বেদনা, সুখের বোধ, তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা ঠিক আমার মতোই তো ছিল!
সকলের মধ্যে সেই গোপন দেখতে না-পাওয়া শিশুটিকে দেখার দিন প্রতিদিন আসে।
আমি প্রায় মনে করি যারা নিজেদের সেই সরল শৈশবকে হারিয়ে ফেলেছে তাদের কত কষ্ট। কারণ তারা পৃথিবীর সবচেয়ে গাঢ় ভালোবাসার অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমিও তো হয়েছি — যখন এনেরোক্সিয়া হয়েছিল আমার — যখন আমার মন থেকে ভালোবাসার সমস্ত অনুভূতি যেন উপে উপে যাচ্ছিল এতো কষ্ট পাচ্ছিলাম মনে মনে। কিন্তু আবার তো সমুদ্রের জোয়ারের মতো সেইসব হারানো অনুভূতি ফিরে পেয়েছিলাম!
আবার ফিরে ফিরে অন্যদের শৈশবের মধ্যে দিয়ে এখনো আমরা সরল অপরূপ দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখার অনুভূতি ফিরে পাবার চেষ্টা করতে পারি।
সকল মানুষের মা দরকার। একজন মা দুইজন মা বা অনেক জন মা কি হতে পারে? পারে হয়ত। যাদের মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তারা কি মা-হারা? এমন তো হতে পারে তারা প্রতি দিন সেই চলে যাওয়া মায়ের সঙ্গে মনে মনে দেখা করেন, কথা বলেন? আশ্রয় ফিরে পান?
আমরা যে মায়ের কাছে ফিরে আসি সেই মায়েরা কী করেন? ক্ষমা করেন। আদর করেন। প্রশ্রয় দেন। শাসন করেন, যে শাসন ব্যথা দেয় না। আমাদের জন্য সব কষ্ট ভোগ করেন, অসাধ্য-সাধন করেন। প্রতিদিন আমাদের সহ্য করেন, আর কেবলই ক্ষমা করেন।
এবার, আমরাও যদি আমাদের একজন মা হতে পারি, তাহলে কেমন হয়?
আমরা যদি নিজেদের মা হতে পারি তবে আমরা নিজেদের এই সব ভুলত্রুটি দেখবো, শুধরে নেবো শুধু না, নিজেদের ক্ষমা করবো, নিজেদের স্নেহের শাসন করবো, নিজেদের রক্ষা করবো, নিজেদের দুঃখবেদনায় নিজেদের সান্ত্বনা জানাবো, আশ্রয় দেবো, নিজেদের ভালো কাজে নিজেদের সাব্বাশ বলবো, নিজেরা সেই শৈশবের সরলতায় রাখার মতো বিশ্বস্ত হাত এগিয়ে দেবো, কখনো নিজেকে ছেড়ে দেবো না, হারিয়ে যেতে দেবো না।
স্নেহ ভালোবাসার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের কাছে ফিরে আসবো, ফিরে থাকবো, আর সেইভাবে সমস্ত মানুষের কাছে একই রকম প্রেমের বলয় হয়ে থাকবো।
মা-দিবসে এই পৃথিবীতে এতো কিছুর মধ্যে এই মানুষের জন্ম পেয়েছি বলে ধন্য হয়েছি। সকল ভালোবাসার মূলে আছে মাতৃরূপ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার কাছে প্রণত হয়ে ভালোবাসা জানাই সকলকে।