রাকিবুল ইসলাম:
উপহার, বকশিশ, উপঢৌকন, ঘুষ, দুর্নীতি এগুলো সব আমার মতে একই সূত্রে গাঁথা। এগুলো বন্ধ করতে হবে। কীভাবে এগুলো একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কিত এবং আমাদের সামাজিক জীবনে মরার উপর খাঁড়ার ঘা স্বরূপ আসে তার কিছু ব্যাখ্যা নিচে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
ক্ষেত্র ১
পারিবারিক, আঞ্চলিক, সামাজিক বা বংশের নিয়মের দোহাই দিয়ে পুত্র বধুর বাড়ি থেকে ইফতার, ঈদ উপহার অথবা সন্তান জন্মের অনুষ্ঠানসহ নানা দিবসকে কেন্দ্র করে উপঢৌকন নেওয়া এখন একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। অনেক দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবার এই দাবি পূরণ করতে গিয়ে সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে যান। আমাদের বিবেক কবে জাগ্রত হবে?
ক্ষেত্র ২
আজকাল বিয়ের সময় পাত্র পক্ষ বলেন যৌতুক নেবেন না, কিন্তু খুশি হয়ে তাঁদের মেয়ের সংসারের জন্য কিছু দিলে আপত্তি নাই। বাস্তবে দেখা যায় ঘরের আসবাবপত্র থেকে টয়লেটের বদনা পর্যন্ত গ্রহণ করেন। মেয়ের বাবার সামর্থ্য না থাকলেও ধার দেনা করে এসব পূরণ করতে হয়। দিতে না পারলে মেয়েকে অনুযোগ শুনতে হয়। উদাহরণ: শাশুড়ি বলছেন “আমরা সমাজ মেনে যৌতুক নেই নাই, কিন্তু অমুকে(…) কইলো পোলারে কই বিয়া দিলেন, মেয়ের বাব এতোই গরীব যে ঘরটা সাজায়ে দিতে পারলোনা, আমার পোলার শশুর তো ক্ষেতে কাম করে এরপরেও তো জামাইরে কিস্তিতে মটর সাইকেল কিনা দিছে”।
ক্ষেত্র ৩
ছেলে খুব সামান্য বেতনে চাকরি করে, ধুমধাম করে বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নাই। এদিকে খালা, মাসিরা বায়না ধরেছেন মুরব্বিয়ানা কাপড় অমুক হিন্দি সিরিয়ালের মত হতে হবে। বাধ্য হয়ে হানিমুন বাদ দিয়ে সামাজিক নিয়ম মানতে কাপড় কিনতে বাধ্য হতে হয়।
ক্ষেত্র ৪
রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে খাবারের মান ও সেবার উপর নির্ভর করে বকশিশ দেওয়ার রীতি অতি পুরাতন। কিন্তু আজকাল সেই রীতি রীতিমতো ডাকাতিতে পরিণত হয়েছে। একই ব্যাপার ঘটে ঈদের সময় বাস, রিকশা বা সিএনজির ভাড়া মেটানোর সময়।
ক্ষেত্র ৫
বিয়ের অনুষ্ঠানে চেয়ার টেবিল দিয়ে ক্যাশ কাউন্টার বসানো হয়। নগদের কদর বেশি, পোলাও মাংস খান আর না খান ঢুকতেই প্রথমে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আমন্ত্রিত অতিথিদের একজনের ও যদি এই দাওয়াত গলার কাটার মত হয় তাহলে আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। বলবেন এখানে উপহার দেওয়া বাধ্যতামূলক না…কিন্তু আপনার আয়োজন আর ক্যাশ কাউন্টার কি সে কথা বলছে? অনেকে তো অনুষ্ঠান শেষে লাভ ক্ষতির হিসাব নিয়ে বসেন। অনুষ্ঠান তো নয় যেন একদিনের এক ব্যবসা। এই ব্যাপারে আহমদুল্লাহ হুজুরের সুন্দর একটি বিশ্লেষণ আছে।
ক্ষেত্র ৬
ধরেন আপনার জন্মদিন অথবা যেকোনো অনুষ্ঠানে বাড়িতে বন্ধুদের দাওয়াত করেছেন। বন্ধুরা কেউ দামী উপহার এনেছেন আবার কেউ তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী কম দামী উপহার এনেছেন। এই পরিস্থিতিতে সাধারণত দুই বন্ধুর মধ্যে একটি ভালো মন্দের তুলনা আপনার মনের মধ্যে চলে আসতে পারে। এমন ঘটনা আমি নিজে চাক্ষুষ করেছি। অথচ কোন উপহার গ্রহণ না করলে কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পরতে হতো না।
ক্ষেত্র ৭
ভালোবাসার হিসাব নিকাশ ও উপহার নির্ভর হয়ে গেছে। এই ঈদে বর্তমান প্রেমিক যদি দামি উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করতে না পারে তাহলে পরবর্তী ঈদ পর্যন্ত সম্পর্ক টিকবে কিনা সন্দেহ আছে। সম্প্রতি এক ভাইরাল ভিডিওতে দেখলাম এক আপুর ৬\৭ জন BF !!! সবার কাছ থেকেই দামী উপহার আদায় করেছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস একদিন সব প্রেমিক একসাথে এসে হাজির। বোঝেন অবস্থা….
ক্ষেত্র ৮
অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক তাঁর পেনশনের টাকা পাওয়ার জটিলতা দূর করতে শিক্ষা অফিস কর্মকর্তার কাছে গেছেন। সেখানেও সফলতা পাওয়ার আগে বকশিশ ধার্য করতে হবে, নইলে ফাইল নড়বে না। যিনি বকশিশ নিচ্ছেন তার কথা হলো, খুশি হয়ে জোর করে দিয়ে যায়, না করলেও শুনে না।
ক্ষেত্র ৯
সরকারি বেশির ভাগ অফিসে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে বড় সাহেব সবাই বকশিশ চান। আপনি খুশি হয়ে তাঁর মন মত বকশিশ বা উপহার দিতে হবে। আপনি লোকাল বাসে ঝুলতে ঝুলতে এখানে গেছেন কিন্তু বকশিশ চাওয়া সামান্য কেরানি ও গাড়ি হাকিয়ে অফিসে আসেন।
ক্ষেত্র ১০
সরকারি হাসপাতাল হচ্ছে বকশিশ বা উপহার অপসংস্কৃতির চরম বাস্তব উদাহরণ। রোগী বহনের চেয়ার থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে বেড পাওয়া সবকিছুই নির্ভর করে আপনার বকশিশ দেওয়ার সামর্থ্যের উপর। রোগী মৃত বা জীবিত যে অবস্থায় থাকুক বকশিশ না দিয়ে পার পাবেন না।
ক্ষেত্র ১১
আপনাকে উপহার দিয়েও একদল ব্যবসা করতে সক্ষম । যেমন সামান্য সিগারেট বিক্রেতা ভাংতি পয়সা না থাকার অজুহাতে কম দামি চকলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুনাফা করে।
ক্ষেত্র ১২
রডের বদলে বাঁশ দেওয়ার দুর্নীতি কেন ঘটে? টেন্ডার পেতে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে বকশিশ বা উপহার দিতে হয়। দুর্নীতি সেখান থেকেই শুরু হয়।
এরপরেও কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন যে একটি দরিদ্র পরিবার যদি কারও কাছ থেকে উপহার পায় তাতে তার অনেক উপকার হতে পারে। কিন্তু আমার যুক্তি হলো গরীব মানুষের তো উপহারের চেয়ে সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন। হাজার গরীবকে কম দামি শাড়ি উপহার দেওয়ার চেয়ে সেই অর্থ একজনকে সহযোগিতা করলে তার জীবন বদলে যেতে পারে।
এখন আপনি বলতে পারেন যার সামর্থ্য আছে তাঁর থেকে নিলে অসুবিধা কী? এতোক্ষণেও বোঝেন নাই, সমাজের এই অসংগতিগুলো দূর করতে হলে শুরুতে একটু কঠোর হওয়া জরুরি। তাই আপাতত সবার কাছ থেকেই উপহার বা বকশিশ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। আর তা শুরু করতে হবে নিজ ঘর থেকেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে কোন উপহার গ্রহণ করবো না। আমার ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান বা বাসায় কেউ এলে একটা ফুল পর্যন্ত না আনার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।