সিমোন দ্য ব্যুভেয়ার এবং নারী

ভানুলাল দাস:

সিমোন দ্য ব্যুভেয়ারের ‘সেকেন্ড সেক্স’ কি ড. হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থের মত, না ‘নারী’ সেকেন্ড সেক্সের মত? আমি অনেক আগে ‘নারী’ পড়েছিলাম, পরে ব্যুভেয়ারের ‘সেকেন্ড সেক্স’ পড়ে দেখি হুমায়ুন আজাদের বইয়ের প্রায় পুরোটাই এর অনুবাদ। বলা যায় কাট এন্ড পেস্ট। তবে এতে ড. হুমায়ুন আজাদকে আমার ছোটো লেখক মনে হয়নি , কারণ বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে সাহস করে আধুনিক ‘নারী জাগরণী’ বার্তা তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন নারী গ্রন্থের মাধ্যমে। এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর পরই মৌলবাদীদের প্রতিবাদের মুখে সরকার নিষিদ্ধ করেছিল, কয়েক বছর পরে হাইকোর্ট এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেয়।

আমি ভয়ে স্ত্রীকে বই দুটি তখন পড়তে দেইনি। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। ভেবেছি, স্ত্রী এতকিছু জেনে গেলে সংসারে আমার আধিপত্য তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে। একেই বলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। দশ বছর পরে আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েকে বই দুটি উপহার দিয়েছিলাম। এখানেও পিতৃতন্ত্রের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড- যা স্ত্রীর বেলায় পুরষ চায় না তা কন্যার বেলায় চায়। পুরুষ অন্যের বোনের সাথে ছুটিয়ে প্রেম করবে, কিন্তু তার বোনকে কেউ প্রেমের প্রস্তাব দিলে ‘মার মার কাট কাট’ অবস্থা করে ছাড়বে।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, আমি এই দুটি বই পড়ে বোধিসত্ত লাভ করেছিলাম। স্বশিক্ষিত হয়েছিলাম। সেই থেকে নারীর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গী আমূল বদলে গেছে। নারী মানে সমস্যা, নারী মানে উটকো ঝামেলা এবং সবকিছুতে সবার আগে নারীর দোষ, এমন মনোভাব থেকে আমি মুক্তি পাই।

‘নারী’ বইটি পড়ে আমি ভীষণ হতচকিত ও বিহ্বল হয়ে যাই। বিশেষত, ‘নারীর শত্রু রবীন্দ্রনাথ’ অধ্যায়টি পড়ে। দার্শনিক রুশো, স্টুয়ার্ড মিল, ও রাসকিন, মেরী ওল্ডক্রাফ্ট, কেট মিলেট, অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তারিত জেনে বুঝে আমি চমকে ওঠি।
নারী যতটা না দেহগত ভিন্ন সত্তা এর চেয়ে অনেক বেশি ভিন্ন ভাবসত্তা। নারী সম্পর্কে পৃথক নেতিবাচক ভাবমূর্তি সেই ছোটোবলা থেকে গড়ে তুলা হয়। ৫/৬ বছর পর্যন্ত ছেলে ও মেয়ের মধ্যে জীবনযাপনে কোনো বৈষম্য করা হয় না। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েশিশু খেলাধূলায়, মেধায়, প্রতিযোগিতায় ছেলেশিশুর চেয়ে এগিয়ে থাকে। তারপর ক্রমশ শুরু হয় নারী বানানোর প্রক্রিয়া। তুমি মেয়ে, তাই ছেলেদের সাথে খেলবে না, গাছে চড়বে না, সাতার দেবে না, ফুটবল খেলবে না। ছেলেদের সাথে খেলাধূলা লজ্জাশরমের বিষয়। তুমি এখন থেকে ঘরে থাকবে, রান্নাবান্না শিখবে, চুল বাঁধবে, সাজসজ্জা করবে, একাকী বাইরে যাবে না, জোরগলায় কথা বলবে না, পুরুষদের সামনে যাবে না… এই ভাবে একটি কন্যাশিশুকে ধীরে ধীরে নারী বানানো চলতে থাকে। আসল সত্য হচ্ছে, নারী একটি নেতিবাচক কনসেপ্ট যা পুরুষতন্ত্র তৈরি। সিম্যুন দ্য ব্যুভেয়ার বলেন-
One is not born, but rather becomes, a woman.
কেউ নারী হয়ে জন্মে না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বিদ্যমান সামাজিকরনের দ্বারা মানুষকে নারী করে গড়ে তোলে। তাই তো, আগে এভাবে কোনোদিন চিন্তাও করিনি! বাঙালি হিন্দু নারীর ‘প্রাণদাতা’ রাজা রামমোহন; কারণ তিনি হিন্দুনারীকে সতীদাহের নামে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা থেকে বাঁচান। আর ‘জীবনদাতা’ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ; তিনি বিধবা বিবাহ চালু করে সতীদাহ থেকে বেঁচে যাওয়া নারীকে জীবন ও সংসার দিয়েছেন। এই দুইজনের কাছে হিন্দু নারীর ঋণ অপরিসীম।

বেগম রোকেয়ার তিরিশ দশকের অগ্রসর চিন্তাধারা ব্যুভেয়ারের কাছাকাছি দেখে আমার চোখ চড়কগাছ।
“মেয়েগুলোকে শিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও, ইহারা নিজেদের অন্ন নিজেরা যোগাড় করে খাউক। নারী স্বাধীনতা আপনি আসিবে।”

প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ফ্রান্সের মহীয়সী নারী দার্শনিক, সাহিত্যক ও নারীবাদী সিমোন দ্যা ব্যুভেয়ার (নারীবাদের আইনস্টাইন নামে খ্যাত) আশির দশকে বেগম রোকেয়ার মতো একই রকম উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন।

“অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া নারী স্বাধীনতা একটি ফাঁকা বুলি মাত্র। পুরুষের অন্ন খেয়ে জীবন ধারণ করে নারী স্বাধীনতা চাওয়া একটি প্যারাডক্স। সবার আগে উপার্জন কর, আর অন্য সবকিছুই পরে হবে। পুরুষের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে এ জগত বিনির্মাণে নারীকে অংশ নিতে হবে। নিজের তৈরি রাজ্যে অন্যকে কেউ রাজা বা রানী বানায় না।”

ব্যুভেয়ার স্বীকার করেছেন, ” মানুষের বসবাসের এই আধুনিক জগত মূলত পুরুষরা শ্রম দিয়ে বানিয়েছে, সেখানে নারীর অবদান তেমন নেই। তাই পুরুষ এখানে নারীকে সমমর্যাদা দিতে নারাজ এবং নারীকে তারা অপর বা আদারস করে রেখেছে।”
তিনি আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, পুরুষ হচ্ছে শ্রেষ্ট- এই দাবির মানে হচ্ছে নারী নিকৃষ্ট, কারণ কাউকে নিকৃষ্ট না রেখে অন্যজন উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ট হতে পারে না। যেমন কোন ছাত্রকে দ্বিতীয় না রেখে পরীক্ষায় কেউ প্রথম হতে পারে না।।
পুরুষ শ্রেষ্ট মানে হচ্ছে নারীকে পুরুষ অপর করে রেখেছে। অপর না করলে নিজের জনকে কেউ নিকৃষ্ট বা হীন করে রাখতে পারে না, বলতেও পারে না আমি শ্রেষ্ট আর তুমি নিকৃষ্ট।

” বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”।

ভানুলাল দাস

ব্যুভেয়ার পড়ে আমার উপলব্ধি হয়েছে, কবি নজরুল ইসলামের উপরোক্ত কবিতার লাইন দুটিতেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। এ সংসারের অর্ধেকের মালিকানা কোনোদিন নারীকে দেয়া হয়নি। কারণ কোনোকিছুর উপর অধিকার সৃষ্টি হয় তার, যার শ্রম ও উদ্যোগে সেই জিনিসটি তৈরি। অনুপ্রেরণা আর সাহস যুগিয়ে নারী কখনো অর্ধেক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয় নি, হবেও না। ব্যুভেয়ারের মতে, নিজ পরিশ্রমের ফসলেই নারীর দাবির ন্যায্যতা পেতে পারে। তাই নারীর উচিত পুরুষের উঞ্চবৃত্তি না করে নিজে উপার্জন করা। যে কোন চাকুরি- পিয়ন থেকে সচিব, পুলিশ, আর্মি, নেভি, বিমানবাহিনী, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক…সকল জায়গায় চাই নারীর পার্টিসিপেশন। তাহলে নারী দাবি করতে পারবে, এ জগত শুধু পুরুষের তৈরি নয়, সত্যিকার অর্থে নারীরও কন্ট্রিবিউশন রয়েছে। আর এ ভাবেই জগতের সবকিছুতে নারীর অধিকার পাওয়ার ন্যায্যতা সৃষ্টি হবে। পুরুষকে মন ভুলিয়ে অলংকার মিললেও অধিকার মেলে না। অধিকার দেওয়ার বিষয় নয়, অর্জনের বিষয়।

ব্যুভেয়ারের আগে এমন স্পষ্ট করে এই কথাগুলো কেউ বলেনি। তিনি মানব সমাজকে সতর্ক করেন এই বলে, “All oppression creates a state of war.” সকল ধরনের নিপীড়নই শেষ অবধি যুদ্ধে গড়ায়। নারীকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে যে বৈষম্য ও নিপীড়ন করা হচ্ছে এর পরিণাম কখনও শুভ হবে না। ক্রমশ পরিবার ও সমাজব্যবস্থার গভীরের শেকড়ে পঁচন ধরবে।

আমি পরিচিত সবাইকে সুযোগ পেলে পরামর্শ দেই, সিমোন দ্য ব্যুভেয়ারের ‘সেকেন্ড সেক্স’ আর হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ পড়বে। এই দুটি বই না পড়লে মানুষ হিসেবে তুমি অসম্পূর্ণ থাকবে। অন্য বিষয়ে যতই তুমি জানো না কেন, নারীবাদ বা ফেমিনিজম সম্পর্কে না জানলে তুমি আজীবন জ্ঞানমূর্খ হয়ে থাকবে।

(লেখক সাবেক ডিআইজি, বিডি পুলিশ)

শেয়ার করুন: