বিল ম্যা(হে)রের একটি অনুষ্ঠানে স্যাম হ্যারিস, আর ম্যার র্যাডিকেল ধর্ম নিয়ে কথা বলছিলেন যেখানে নারী-পুরুষের অসমতা, ধর্মত্যাগী আর সমকামী বিদ্বেষ, মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। বেন এফ্লিক এর মধ্যে হঠাৎ করেই হ্যারিস আর ম্যারকে বর্ণবাদী বলে অভিযোগ করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজন পাকিস্তানি-কানাডিয়ান ব্লগার এবং সমাজকর্মী বেন এফ্লিককে একটি চিঠি লিখলেন। নিচে সেই চিঠিটি অনুবাদ করেছেন ওয়াহিদা নূর আফজা
প্রিয় বেন,
আপনাকে লেখা এই চিঠিটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ আর বেড়ে উঠা একজন নারীর। বিল মাহের এবং স্যাম হ্যারিসের সাথে আপনার আলোচনাটি দেখলাম, এবং আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমাদের ভালো করতে গিয়ে বরং খুব ক্ষতি করে ফেললেন। আপনার সদিচ্ছা নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই। সে মুহূর্তে আপনি হয়তো আন্তরিকভাবেই ঐ দু’জনের কাছে থেকে মুসলিমদের রক্ষা করতে চাচ্ছিলেন।
কখনই আলোচিত না হওয়া একটি বিষয়বস্তু নিয়ে দু’জন লোক একটি সংলাপ শুরু করার চেষ্টা করছিলেন, অথচ আপনি তা শুনতেই চাইলেন না। এর গোড়াতেই পানি ঢেলে দিলেন, খুব সম্ভবত অসাবধানতাবশত। বেন, আপনার কেন মনে হলো এই বিষয়টি সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা উচিত?
শতাব্দী পেড়িয়ে যাচ্ছে তারপরও কেন মুসলমানদের যেন সেই আদি নিয়মের ঘেরাটোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে? একজন নারীকে খাদ্যবস্তুর (ক্যান্ডি) সাথে তুলনা করাকে কি আপনি ঠিক বলে মনে করেন? সারা পৃথিবীর নারীরা যখন তাদের স্বাধীনতা আর সমতার জন্য লড়ছে তখন কেন আমাদের বলা হচ্ছে এই লজ্জাজনক শরীরটাকে ঢেকে রাখতে হবে? আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে একুশ শতকের অভিজাত ক্লাবের সদস্যদের থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি?
আপনার মতো উদারপন্থীরা গোঁড়া মুসলিমদের পক্ষে আর ইসলামফোবের বিপক্ষে, স্বীকার করছি এর উদ্দেশ্য মহান, কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন আমরা যারা ধর্মের কারণে নিপীড়িত আর কোণঠাসা অনুভব করছি তাদের পক্ষে কে আছে? যতবারই আমরা আমাদের কণ্ঠস্বর জোড়াল করি, ততবারই আমাদের কেউ না কেউ খুন হচ্ছে বা হুমকি পাচ্ছে। আমি একজন ব্লগার এবং অঙ্কনশিল্পী, কারও জন্য হুমকি স্বরূপ নয়, বেন, শুধু যারা শব্দ এবং আঁকাআঁকিকে ভয় পায় তারা ছাড়া। নিজেকে নির্দ্বিধায় প্রকাশ করলে আমাকে খুন হয়ে যেতে হবে না, এইটুকু চাওয়া কি খুব বেশী?
আমি একবার শিশুদের জন্য একটা বই লিখেছিলাম। সেখানে বলতে চেয়েছিলাম মানুষের ধ্যানধারণা, জীবনাচারণের মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু তা স্বত্বেও তারা পৃথিবীতে এক ছাতার নীচে অবস্থান করতে পারে। কিন্তু এতে আমার জীবন বদলে যায়। আমার বই, ‘আমার চাচা সমকামী’-তে নির্দোষ অ্যান্টি-হোমোফোবিয়া বার্তা রয়েছে, ‘ভালবাসা সবার জন্য’। আমার মুসলিম ভাইবোনেরা এটাকে ভাল চোখে দেখেনি।
সেই প্রকল্পের পর থেকে আমাকে ‘গডের শত্রু’ ঘোষণা করা হয়েছে এবং মাথার উপর তাদের দেওয়া অলিখিত মৃত্যুদণ্ড ঝুলছে। আমি এমন একটা বিশ্ব দেখতে চাই যেখানে দক্ষিণ এশীয় শিশুরা নির্ভয়ে সব ধরণের গল্প বলতে এবং শুনতে পারবে, ভালবাসার ফল্গুধারা অফুরন্ত – এই নিষ্পাপ ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠবে। আমার মুসলিম ভাই-বোনদের অনুভূতিতে এটি কঠোরভাবে আঘাত করে কারণ নিজেদের ভেতরকার সমকামী বিদ্বেষকে এতে উন্মোচিত হয়। পশ্চিমাদের মতিগতির অধঃপতন বলে এই বিষয়টিকে তারা একদম উড়িয়ে দিতে পারেনা। তারা যেমন অস্বীকার করে যে ইসলামের মধ্যে কোন ভুল আছে, ঠিক তেমনি তারা মনে করে যে কোন ভালো মুসলিম সমকামী হতে পারে না। এভাবেই লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। বেন, অনুগ্রহ করে আপনি এইসব চিন্তাধারার মানুষদের রক্ষা করতে যাবেন না, বিশ্বাস করেন অনেক ‘ভালো’ মুসলিমই এইভাবে চিন্তা করে।
চিৎকার করে ‘বর্ণবাদী!’ বলে আপনি স্যাম হ্যারিস আর বিল ম্যা(হে)র ইসলামের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনার পথটি প্রথমেই বন্ধ করে দিতে চাইলেন। হয়ে উঠলেন ইসলামের রক্ষক। কিন্তু আপনি কি জানেন আমাদের মতো অনেক মুসলিম আছে যারা চায় যে এই ধরনের আলোচনাটি চলুক! আর কতোদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এটি বলার জন্য যে ইসলাম জীবনাচরণের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে? হ্যাঁ, সমাজে ইসলামফোবিয়া আছে। আমেরিকাতে মুসলিম নাম এবং বাদামী গাত্রবর্ণের কারণে এই ভীতির মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। পাতাল রেলে আমার শান্তিকামী আত্মীয়দের বিনা কারণে ‘সন্ত্রাসী’ বলে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি আমি বুঝতে পেরেছি।
একটি মতাদর্শের সমালোচনা করা এবং একদল লোকের প্রতি বিদ্বেষী হওয়া আদতে এক নয়। আর এ কারণে আমি মনে করি ইসলামের অন্তর্গত বিষয়গুলো নিয়ে খুব সতর্কতার সাথে দ্বিমুখী আলোচনা হওয়া উচিত। মতাদর্শগুলো আলোচিত হবে ঠিকই, কিন্তু তা হবে সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি নিরপেক্ষ।
রাজনৈতিকভাবে সঠিক এবং ‘উদার’ হওয়ার স্বার্থে আমরা লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে ফেলছি। আমি আপনার দিকে ফিরে যাচ্ছি কারণ আপনি এই কথোপকথন শুরু করার জন্য সহায়ক ছিলেন। আমরা যারা সংস্কার চাই তারা চরমপন্থীদের কারণে বোবা হয়ে আছি, সেইসাথে উদারপন্থীরাও বহুসংস্কৃতির নামে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
আইসিস একটি ভয়ঙ্কর ছবি এঁকেছে, তাই কোন লিংকে অস্বীকার করতে আমার হাঁটু কাঁপে। বেশিরভাগ মুসলমান ধর্মগ্রন্থের শান্তিপূর্ন ব্যাখ্যা বেছে নেয়, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে ধর্মগ্রন্থের সহিংস ব্যাখ্যার প্রচলন নেই। সহিংস ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো অনেক আয়াত ধর্মেগ্রন্থে আছে। আমাদের সেটি চিহ্নিত করতে হবে।
আমরা কি এক সেকেন্ডের জন্য নির্লজ্জ দ্বিমুখী নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে কথা বলতে পারি? পশ্চিমা দেশগুলিতে সাধারণত কোনও সমস্যা ছাড়াই মসজিদ তৈরি করা যায়। কিন্তু ইসলামের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরবে মুসলমান ছাড়া আর অন্য কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারে না। এখানে কোন গির্জা, মন্দির বা অন্য ধর্মের কোন উপাসনালয় নেই কারণ সৌদি আরব কোন অমুসলিম উপাসনালয় তৈরির অনুমতি দেয় না। ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বললেই যদি আমরা তাদের চুপ করে দেই তাহলে এই ধরনের অন্যায়ের জন্য কে তাদের জবাবদিহি করবে?
একবিংশ শতাব্দীর সাথে তাল মিলিয়ে চলার ইচ্ছা থাকাটা কি খুব দোষের? এ চাওয়ার মধ্যে তো কোন সংকোচ দেখি না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমস্ত ধর্মীয় গ্রন্থে সহিংসতা, নারী এবং সমকামিতার উপর বিদ্বেষ বিদ্যমান, তবে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা আজ পর্যন্ত তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে।
পশ্চিমে এই রকম অক্ষরে অক্ষরে যারা ধর্মীয় উগ্রবাদ লালন করে তাদের সহজেই “পাগল” বলার বিলাসিতা আছে, যেমন ওয়েস্টবোরো ব্যাপটিস্ট চার্চের মতো। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে, এই জাতীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকে এটাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করবে, বিশ্বাস করুন আমার কথাগুলো পর্দার নক্সাদার ঝালরের মতো বিলাসী বস্তু নয়। মুসলিমদের অধিকাংশই প্রকাশ্যে প্রাচীন শরিয়া আইনের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাইবে না। তাদের জন্য ব্লাসফেমি আইন কিম্বা একঘরে হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। এ দুটোই মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট। যারা ধর্মান্ধ নয় তারা একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া আর দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করতে পারলেই খুশী। কোন ধর্মীয় সংস্কারের কথা তারা ভাববে না। এজন্যই ব্লাসফেমি আইন/ধর্মত্যাগের অপবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রতিবাদকারীদের কোথাও দেখা যায় না। শরীয়া আইনের রক্ষণশীল ব্যখ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মুসলমানরা কোথায়? এই স্যান্ডউইচ-খাওয়া শান্তিপ্রিয় লোকেরা দুর্দশাগ্রস্ত আফগানিস্তান বা রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করতে সেখানে যাবে না।
বেন, এবং আমাদের সমস্যা এখানেই।
বিল ম্যা(হে)র এবং হ্যারিসের কথাগুলো যদি নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে আসতো তাহলে তা সহজে হজম করা যেত। নিজ সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রতিবাদ করছে না, অন্যজন করছে এই বিষয়টি আপনাকে আহত করেছে। তা আমি বুঝতে পেরেছি এবং এ জন্য আপনাকে প্রশংসাও করছি। আর এ কারণেই আমি আপনাকে লিখছি আমার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে।
মুসলমানরা তাদের নিজেদের নৃশংসতার সমালোচনা না করলে বাইরের মানুষেরা তা করবে (মুসলিম রিফিউজিদের কারণে ইউরোপ ব্যতিব্যস্ত, তাই অমুসলিমরা মুসলিমদের সমালোচনা করে থাকে)। আবার বাইরের লোকে সমালোচনা করছে বলে তা প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। তাই তার গুরুত্বও নেই। এটি একটি দুষ্টচক্র। হ্যারিসের মতে, সত্যিকারের সংস্কারপন্থীদের শক্তিশালী করে এই চক্র ভাঙতে হবে।
অনুগ্রহপূর্বক তাদের খুঁজে বের করুন এবং সাহায্য করুন।
বাবা, স্বামী বা ভাই ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে আমার দেখা করার অনুমতি নেই। তাই কোথাও বসে আপনার সাথে যে আমি একটি আলোচনা করবো, তারও উপায় নেই। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন, অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।