অসবর্ণ বিয়ের বাধা দূর হোক

ভানুলাল দাস:

হিন্দু সমাজে বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদ রয়েছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র এ রকম চারটি বর্ণ রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুতে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকে খুব বেশি দেখা যায়। মূলত, ব্রাহ্মণ ও শুদ্র, এই দুই বর্ণের আধিক্য এখানে। বর্ণভেদের দ্বারা জন্মগতভাবে উচ্চবর্ণের লোকজন বিশেষ সামাজিক মর্যাদা পেয়ে থাকে। ধর্মকর্মেও তারা বিশেষ অধিকার পেয়ে থাকেন। এই বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার অক্ষুন্ন রাখার জন্য তথাকথিত উচ্চবর্ণরা রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে চায়। তাই তারা ধর্মের নামে বর্ণপ্রথা চালু রেখে নিম্নবর্ণের লোকদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় না। দুই ভিন্ন বর্ণের ছেলেমেয়ের বিবাহকে অসবর্ণ বিয়ে বলে। অসবর্ণ বাংলাদেশের হিন্দু সমাজে এখনও অগ্রহণযোগ্য।

উঁচু তিন বর্ণের লোকদের বলে দ্বিজ এবং সকল দ্বিজের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। এই রকেট সায়েন্সের যুগে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হচ্ছে, হিন্দুদের বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদ। হিন্দু ছাড়া সারা দুনিয়ার কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষকে বোঝানো সম্ভব নয় যে, এক ধর্ম, এক ভাষা, একই গাত্রবর্ণের মানুষগুলো এক অলঙ্ঘনীয় দেয়াল দ্বারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। এই দেয়ালের নাম বর্ণপ্রথা। ধর্মের নামে এই বর্ণ হিন্দুকে প্রধানত পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র ও অতিশুদ্র (অস্পৃশ্য)।

এই বর্ণ প্রথার কুপ্রভাবে প্রত্যেকটি প্রধান বর্ণ আরও অনেক রকম উপবর্ণ ও উপজাতে বিভক্ত হয়েছে। যেমন, শুদ্রদের মধ্যে ৩৬ প্রকার, মতান্তরে ৪২ রকম উপজাত রয়েছে। এই শুদ্র উপজাতগুলো আবার উত্তম শুদ্র, মধ্যম শুদ্র ও অধম শুদ্র, এমন তিন ভাগে বিভক্ত। উত্তম শুদ্র বা জলছোঁয়া শুদ্ররা হলো কায়স্থ, বারুজীবী, কামার প্রমুখ ১২ উপজাতের হিন্দু, যারা কায়স্থের ব্রাহ্মণের যজমান; এদের হাতের ছোঁয়া পানি (ভাত নয়) ব্রাহ্মণকে পান করার শাস্ত্রীয় অনুমতি আছে, এরা ছুঁইলে ব্রাহ্মণ অপবিত্র হবে না। এরপর মধ্যম শুদ্র-, মালি, বণিক, সাহা, তেলি, তক্ষক, ধোপা, জেলে, মাঝি ইত্যাদি। এদের হাতে ছোঁয়া পানি ব্রাহ্মণের খাওয়া শাস্ত্র নিষিদ্ধ, তবে এরা ব্রাহ্মণকে ছুঁইলে ব্রাহ্মণ অপবিত্র হবে না। সব শেষ অধম শুদ্র- নমঃশুদ্র, হাড়ি, মুচি, ডোম, মেথর ইত্যাদি। এদের হাতের ছোঁয়া জল বামুন খাবে না, এরা বামুনের অস্পৃশ্য। এদের ছোঁয়া লাগলো ব্রাহ্মণ অশুচি হবে!

বর্ণপ্রথার কুফল স্বরূপ এই ভাগাভাগির কারণে শুদ্ররাও একজাতি হতে পারেনি। এদের মধ্যে আন্তঃবিবাহ তেমন চালু হয়নি।
এ ছাড়া কুলিন ব্রাহ্মণ (ভট্টাচার্য, গাঙ্গুলি, চ্যাটার্জী, ব্যানার্জি ইত্যাদি) ও অকুলিন ব্রাহ্মণ (যারা মধ্যম শুদ্রের পুরোহিত), পতিত বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ও রাঢ়ী ব্রাহ্মণ, এমন বিভক্তি ব্রাহ্মণেও রয়েছে। এই সকল ব্রাহ্মণদের মধ্যেও আন্তঃবিবাহ হয় না। আবার গোত্র এক হলে দুই জেলার দুই পরিবারের ছেলেমেয়ের বিয়ে হবে না।

একই ধর্মের লোকের ভেতর শুধুমাত্র অযৌক্তিক বর্ণভেদের কারণে বিবাহ না হওয়ার জন্য রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হচ্ছে না। সমাজতত্ত্ব বলে, রক্ত সম্পর্ক বা রক্ত সম্পর্কের সম্ভাবনাময় গোষ্ঠীর মধ্যে একত্ব, ঐক্য ও শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী মনোভাব গড়ে উঠে।

হিন্দুর বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ করুণ এবং আমরা সবাই জানি। পালপাড়ার লোকজনের সমস্যা হলো, কিন্তু প্রতিবেশি বণিকপাড়া নিষ্পৃহ রইলো। কারণ এদের মধ্যে রক্তসম্পর্কের আত্মীয়তা নেই। চরম বিপদে রক্ত সম্পর্ক ছাড়া কেউ এগিয়ে আসে না, পাশে থাকে না। তাই একদিন সকালে দেখা গেল পালপাড়ার লোকজন বাস্তুভিটা ছেড়ে চলে গেছে। বণিকরা এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করলো না। বণিক সমাজ বুঝলো না যে পরবর্তী টার্গেট বণিকগণ। এইভাবে একে একে নিভিছে হিন্দুর দেউটি। হিন্দুর বিভিন্ন জাত উপজাত এমন এক একটি ইট যার মাঝখানে সিমেন্ট নেই, লোহার বীম নেই, ফলে সামান্য ধাক্কা খেলে দেয়ালটা সহজে ধ্বসে পড়ে।

হিন্দু সমাজ বর্ণপ্রথা হিন্দুর মগজে পাইলোজনিক পজেসনের মত কেন রয়ে গেল? কেন আজও অধিকাংশ হিন্দু বর্ণপ্রথার নিরব সমর্থক? আত্মঘাতি হিন্দুরা নিজের সর্বনাশ নিজেরা চেয়ে চেয়ে দেখছে। আজও দেখছে, কালও দেখেছে। আগামীতেও কি দেখে যাবে? হিন্দু থিংকট্যাংক কি এই নিয়ে ভাববে না?

আমার পরিচত এক ব্রহ্মজ্ঞানী ব্রাহ্মণকে বলেছি, ঠাকুর মশাই, হিন্দু যে শেষ হয়ে গেল!
তিনি বললেন, গিয়ে টিয়ে যারা থাকে তারা খাঁটি সনাতন। মোক্ষ তো কোটিতে একজন পাবে।
ব্রাহ্মণ ঠাকুরের ভেতরের কথাটি হলো, যে যায় যাক, আমার বর্ণ কর্তৃত্ব থাকলেই হলো।
আমার কেন জানি মনে হয়, বর্ণ হিন্দু শ্রেণি হিসেবে হিন্দুর মঙ্গল চায় না। যে কোনো মূল্যে বর্ণপ্রথা টিকিয়ে রাখতে চায়, এতে যদি হিন্দু সমাজ গোল্লায় যায় যাক। তারা চায় বর্ণপ্রথা বহাল রেখে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ এক জাতিতে পরিণত হোক। তারা কেন বুঝে না, বর্ণপ্রথার মত মানবতাবিরোধী প্রথা রেখে হিন্দুর ঐক্য চাওয়া সে এক রকম সোনার পাথর বাটিতে মুড়িদুধ খাইতে চাওয়া।

ইসকন ও রামকৃষ্ণ মিশনকে বর্ণপ্রথার সমর্থকরা অবজ্ঞা করে। কারণ সেখানে সীমিত পরিসরে হলেও বর্ণপ্রথা না মেনে শুদ্রকে সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারী করা হয়। পূজাপার্বণ ব্রহ্মচারী শুদ্ররা করে, সেখানে জন্মবামুনকে পৌরহিত্য করতে ডাকা হয় না। গোস্সা হওয়ার প্রধান কারণ বোধহয় এই!

ভারতের কেরালায় এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে দলিত শ্রেণির এক রাজনীতিবিদ (এমএলএ) গোপনে বিয়ে করেন। এতে বর্ণপ্রথার সমর্থকগণ এমন বেপোরোয়া হয়ে ওঠে যে শেষে হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। হাইকোর্টকে বলতে হয়েছে, ব্রাহ্মিণ কন্যার দলিত স্বামী হতে আইনে বাঁধা নাই।
বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা এমনি কমে গেছে। এর মধ্য জাতে জাতে, জাতে উপজাতে, উপজাতে উপজাতে বর্নপ্রথা, বর্ণঘৃণা এমনভাবে নিরবে কাজ করছে যে, হিন্দু ছেলেমেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রপাত্রী পাওয়া দু:সাধ্য হয়ে পড়েছে। যুবক যুবতীদের সামনে জীবনসঙ্গী করার মত পর্যাপ্ত অপশন রাখা যাচ্ছে না। আর এর সুযোগ নিচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা। অচিরে এর সমাধান করা না গেলে হিন্দুর ক্ষয়িষ্ণুতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থায় আমরা কি ঝড়েপড়া উটপাখির মতো বালিতে মুখ বুঁজে থাকবো? কিন্তু চোখ বুঁজে থাকলেই কি প্রলয় বন্ধ হবে?

#প্রস্তাবিত হিন্দু সংস্কার আইন পার্লমেন্টে পাস হোক এবং অসবর্ণ বিয়ের প্রতিবন্ধকতা দূর হোক। হিন্দু বাঁচুক।

(লেখক সাবেক ডিআইজি, বাংলাদেশ পুলিশ)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.