টিপ ও হিজাবের প্রশ্নে স্ববিরোধ

পুলক ঘটক:

বোরকা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে বিতর্ক আছে এবং কোনো কোনো দেশে নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলে বোরকা পরায় নিষেধাজ্ঞাও আছে। কিন্তু মাওলানা সাহেবদের পাঞ্জাবী-পায়জামা পরার ব্যাপারে কিংবা অন্যান্য ধর্মের পুরুষদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশক পোশাকসমূহ নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি বা নিষেধাজ্ঞার কথা শোনা যায় না। কেন? কারণ হলো, দুনিয়া জুড়ে নারীর স্বাধীনতা বা নারীমুক্তি একটি ইস্যু। কারণ হলো, সমাজ পুরুষতান্ত্রিক এবং এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীমুক্তি ও নারী উন্নয়নের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

লিঙ্গনিপীড়নমূলক পুরুষতন্ত্রে পোশাকের নামে পুরুষকে বন্দীত্ব উপহার দেওয়ার ভয় নেই। কিন্তু পোশাক বা পরিধানের নামে নারীকে পদে পদে প্রতিকূলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি বিশ্বজুড়ে প্রমাণিত সত্য। প্রাচীনকালে চীন দেশে নারীদের পা ছোট রাখার জন্য লোহার জুতা পরিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে শুরু করে আধুনিককালে নয়া ধর্মীয় আন্দোলনের মাধ্যমে নারীকে সর্বাঙ্গে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা গোপন কিছু নয়। নারীকে সমাজজীবন থেকে আড়াল করার চেষ্টা আছে। তাতে শুধু নারীকে জীবনবিচ্ছিন্ন করা নয়; নারীর স্বাভাবিক পথচলা, বৈচিত্র্যময়  রুচীশীল জীবনযাপন এবং বহুমুখী কর্মে প্রবেশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।

নৃত্যশিল্পীদের জন্য বোরকা সুবিধাজনক নয়; অভিনয় শিল্পী যে চরিত্রে অভিনয় করবেন – সেই পোশাকই তাকে পরতে হবে। প্রশ্ন হলো, নারীদের অভিনয় করার অধিকার আছে কী নেই? বোরকা পরে ফুটবল খেলা সুবিধাজনক নয়। বোরকা পরে কুংফু কারাতে প্রাকটিস করা অসুবিধাজনক। কুংফু কারাতে শেখার অধিকার নারীর আছে কি নেই? এরকমভাবে জীবনের যতরকম বৈচিত্রময় কাজ আছে, তা করার অধিকার আপনার-আমার মেয়েদের আছে। তাই বিশেষ পোশাক পরিয়ে নারীকে এই বিপুল কর্মময় পৃথিবী থেকে আড়াল করে দেওয়ার চেষ্টা সবাই ভালভাবে নেবে না।

শুধু বোরকা কেন? বাঙালি নারীর শাড়ি এবং উঁচু গোঁড়ালির (হাইহিল) জুতার মতো পরিধানও সকল কর্মের জন্য উপযোগী নয়। যে পোশাক পরে স্বচ্ছন্দে দৌড়ানো যায় সেটাই আসলে কর্মের উপযোগী ভালো পোশাক। ভাগ্য ভালো শাড়ি বাংলাদেশে প্রচলিত সংস্কৃতিমাত্র,; ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা নয়। হিন্দুদের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হিসেবে নারীদের উপর শাড়ি পরার বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া হলে এর বিরুদ্ধেও নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীদের জোরেশোরে বলতে হতো।

পোশাক জিনিসটা ধ্রুব নয়; আপেক্ষিক –বিশেষ করে জলবায়ু ও পরিবেশ সাপেক্ষ। অতিমাত্রায় শীতপ্রধান অঞ্চলে বোরকা বা শাড়ির মতো পোশাকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। মানুষের রুচিবোধ এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনধারার উপর পোশাক নির্ভরশীল। পোশাক কেমন হলে তা ধর্মীয় হবে, দর্জি সাহেব আমার পাঞ্জাবীটা কোন ডিজাইনে বানিয়ে দিলে সেটা ধর্মের বাইরে চলে যাবে না –এরকম নিখুঁতভাবে ধর্মীয় পুস্তকে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে কি-না আমি জানি না। বোরকা বা হিজাব কেমন হলে সেটা ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে –এ বিষয়ে ইসলামপন্থী পণ্ডিত এবং মাওলানারা সবাই একমত নন। অনেকেই বলেছেন শীতপ্রধান দেশে বাঁচার জন্য যে ভারী পোশাক পরতে হয়, সেটাকেই হিজাব হিসেবে মানা যাবে। একই বিবেচনায় ছাত্রীদের স্কুল ড্রেস, পুলিশ এবং সেনাসহ বিভিন্ন বাহিনীর যে ইউনিফরম, ডাক্তার এবং নার্সদের সাদা অ্যাপ্রন, আইনজীবী এবং বিচারকদের কোট ও গাউন হিজাব হিসেবেই গণ্য। আবার অনেকেই মনে করেন নারীর পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ঢেকে রাখাই ধর্ম। সেজন্য তারা বোরকা এবং নেকাবের সঙ্গে হাতে ও পায়ে মোজা পরার ব্যবস্থা দিয়েছেন।

টিপ পরার স্বাধীনতা থাকলে বোরকা পরারও স্বাধীনতা থাকতে হবে –এই কথাটি আসলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অযৌক্তিক। টিপ পরার স্বাধীনতা থাকলে শিকল পরারও স্বাধীনতা থাকতে হবে – এরকম কথা কেউ বললে গোঁজামিলটা শিশুরাও বোঝার কথা। কিন্তু আমাদের চারপাশের বয়স্ক শিশুরা এটা বোঝেন না।

বলা হচ্ছে হিজাব নারীর চয়েস। কেউ স্বেচ্ছায় আত্মঘাতি হতে চাইলে তা কি সমর্থন করা যায়? আসলে কেউ কি স্বেচ্ছায় বন্দীত্বের পোশাক পরতে চায়, নাকি শিশুকাল থেকে তাকে এমন অরিয়েন্টেশন দেওয়া হয়, যাতে সে সমাজে মুক্তভাবে বাঁচার চিন্তা ভুলে যায়? একজন মানুষের পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা –হাতেপায়ে মোজা এবং চোখমুখ সবকিছু ঢেকে রাখা, যাতে সমাজের মানুষ তাকে দেখতে না পায় –সে যেন সমাজের একজন হয়ে উঠতে না পারে –এরকমভাবে একজন মানুষের অস্তিত্বকে জীবিত অবস্থায় শেষ করে দেওয়ার চিন্তা সবাই সমর্থন করতে পারে না।

আমি টিপ পরার স্বাধীনতাকে সমর্থন করেছি অথচ হিজাবের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছি; অতএব আমি স্ববিরোধী – গত কয়েকদিন যাবত এই অভিযোগ যারা করছেন তারা শুনে রাখুন:

পোশাক নিয়ে এই আলোচনা বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষমূলক আলোচনা হলে মাওলানা সাহেবদের পোশাক নিয়েও সমালোচনা করতাম। পুরুষের ধর্মীয় পোশাক নিয়ে কথা বলি না, কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের স্বাধীনতা হারানোর ভীতি নেই। যা কিছুই নারীর স্বাধীনতাকে হরণ করে, নারীর মুক্ত বিচরণ ও কর্মের স্বাধীনতা বিঘ্নিত করে, নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে যা কিছুই প্রতিবন্ধক আমি তার বিপক্ষে। এটা নতুন কিছু নয়। আপনি ধর্মের নামে হোক বা যে কোনো অজুহাতে হোক –নারীকে গৃহবন্দি বা অবরোধবাসিনী করতে চাইলে আমি তা পছন্দ করব কেন? আমি তার বিরুদ্ধে কলম ধরবই। কোনো মানুষকে কবরের অন্ধকারে ঢুকিয়ে রাখতে চাইলে আমি তা সমর্থন করতে পারি না। পৃথিবীর দেশে দেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীরা পোশাকের নামে নারীজাতিকে শৃঙ্খলিত করার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।

টিপ কাউকে শৃঙ্খলিত করে না। নারীর সৌন্দর্য চর্চায় কেউ বাধা দেয় না; কোনো সভ্য মানুষ বাধা দেয় না। পোশাক এবং প্রসাধনীর বিরুদ্ধে কেউ নয়; কিন্তু পোশাকের নামে নারীজাতিকে জীবনবিচ্ছিন্ন করার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে মানবতা।

যে বিষয়ে আমি বলছি, একই বিষয়ে মুসলিম পরিচয়ের একজন প্রগতিশীল মানুষ বললে দুইজনের কথাকে দুইভাবে কেন দেখেন? বোরকা বা হিজাব পরা কি পৃথিবীতে সবার জন্য বাধ্যতামূলক? বিষয়টি অপছন্দের –এমন মতামত প্রকাশ করাও কি ধর্মবিরোধী? তাহলে সবাই একমত হয়ে আসুন, সবাই মিলে বলুন সাইবেরিয়ার শীতেও বোরকা পরাই একমাত্র ধর্ম। এ বিষয়ে ভিন্নমতের জায়গা বন্ধ করে দিন।

শেষ কথা শুনুন: আমি হিজাব পরা ভালো মনে করি বা না করি –হিজাব পরার কারণে রাস্তায় কোনো নারীকে কখনোই উপহাস করবো না। জীবনে কখনো এরকম কাজ করিনি, করবোও না। যা কিছু বলি তা মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকে বলি। মানুষের বুদ্ধির মুক্তির জন্য লেখি। মানববিদ্বেষ আমাদের চর্চার মধ্যেই নেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.