যে বিষে জাতি আজ মেধাহীন, চেতনাহীন

তানিয়া নাসরীন তৃপ্তি:

কোন জাতি বা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে হলে সবচেয়ে কার্যকরি পন্থা হলো সে জাতিকে মেধা শূন্য করা। এই বঙ্গভূমিতে রাজনৈতিক স্বার্থে মেধা শূন্যকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে। মাকড়সা যেমন ধীরে ধীরে জাল বুনে শিকার ধরার জন্য অপেক্ষা করে, তেমনই সেই স্বাধীনতা পরবর্তী মাকড়সা চক্র বহুবছর ধরেই সিল্কের আঠালো সাম্প্রদায়িকতার জাল বুনে ঘিরে ফেলেছে ছোট্ট এই দেশটির সকল প্রান্ত। আর সেই জালে আটকা পড়া শিকার বাঙালি সমাজকে ধীরে ধীরে বিষ ক্ষরণ করে মেরে ফেলছে অথবা অচেতন করে ফেলছে। ধীর গতির এই প্রক্রিয়াতে মৃতের সংখ্যা হয়তো এখনও কম কিন্তু অচেতন পুরো জাতি।

১৯৭১ এ পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পেরেছিল পরাজয় নিশ্চিত, তখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে মেধাশূন্য করে গিয়েছিলো। পাকিস্তানিরা চলে গেলেও মেধাশূন্যকরণ প্রক্রিয়া কিন্তু শেষ হয়নি। ১৪ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ শুরু হয়ে সে প্রক্রিয়া চলমান আজও। তাইতো স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ৫০ বছরেও সেভাবে মেধার বিকাশ ঘটতে দেয়া হয়নি যেভাবে ষাটের দশকে গণজাগরণ হয়েছিলো।

ষাটের দশকের সেই জাগরণ, শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশই এই দেশকে স্বাধীনতার মুখ দেখিয়েছিলো। কিন্তু এই ২১ শতকে এসে এদেশ যদি পাকিস্তান বা আফগানিস্তান দখল করে নেই তাহলে আর মুক্তির জন্য যুদ্ধ হবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ এক মেধাশূণ্য, ধর্মান্ধ ও সামপ্রদায়িক জাতির বিকাশ ঘটানো হয়েছে এই ৫০ বছর ধরে; শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতিকে করা হয়েছে ধ্বংস।

কিছু সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ বা অবস্থা এক্ষেত্রে আলোচ্য। দেশের রাজধানী ঢাকা ; স্বাভাবিকভাবেই সবধরনের উন্নয়ন ও বিকাশ এখানেই সর্বাগ্রে হবে। এই ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর মূল উদ্দেশ্য আর সুশিক্ষিত জাতি গড়া নয়; এদের মুল উদ্দেশ্য ভালো রেজাল্ট। এসব স্কুলে সৃজনশীল পদ্ধতির নামে মুখস্থ বিদ্যা শেখানো হয়; নেই কোন সাংস্কৃতিক চর্চা। ঢাকার নামিদামি স্কুলগুলোতে কো-এডুকেশনের ব্যবস্থা নেই। ছেলে মেয়ে আলাদা শিফটে ক্লাস হয়। মেয়েদের মর্নিং শিফটে আর ছেলেদের ডে শিফটে। এই সিস্টেমের যৌক্তিকতা কি? বা আমরা একদিনেই এমন সিস্টেমে চলে এলাম সেরকম ও নয়। সংবিধানে নারী পুরুষ ধর্ম জাতি গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের অধিকার সমান এবং কারো প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বা বৈষম্য সৃষ্টিকারী কোন কাজ না করার উল্লেখ থাকলেও ছোট্ট ছোট্ট কোমলমতি শিশুদের মনে আমরা এই আলাদা শিফট ক্লাসের ব্যবস্থার মাধ্যমেই বপন করে দিচ্ছি নারী পুরুষ বিভেদ।

নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই আকর্ষণ বোধ বেশি হয় মানুষের; শিশুদের তো আরও বেশি হয়। আর পুরুষের ক্ষেত্রে নারী বা নারীর ক্ষেত্রে পুরুষ কেনই না নিষিদ্ধ হবে। নারী পুরুষ মিলেল তো মানবগোষ্ঠী। আমরা একে অপরের পরিপূরক। নরনারীর সহবস্থানেই তো টিকে আছে পৃথিবী। তাহলে এমন আলাদা অস্পৃশ্য করে রাখার প্রয়োজনীয়তাই বা কি! আমি মফস্বল শহরের স্কুলে পড়াশোনা করেছি ছেলে মেয়ে একসাথে। শৈশব কৈশোর ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এক সাথে খেলে, এক বেঞ্চে বসে পার করেছি। কখনও মনে হয়নি ছেলেরা আলাদা কিছু। লিঙ্গ, বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে আমরা মানুষ এটাই তো সবার আগে শিক্ষনীয়।

আমার ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে ঢাকার একটি নামকরা পুরাতন স্কুলে। যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো একজন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর হাত ধরে। ঢাকার অন্যান্য স্কুলের মতই এখানে ছেলে মেয়েদের ক্লাস আলাদা শিফটে হয়। ক্লাস শেষ করে মেয়েরা বের হওয়ার পর ছেলেদেরকে স্কুল ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়া হয়। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ছেলেদেরকে এল্যাও করা হয় মেয়েদের ক্লাস চলাকালীন সময়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার। কিন্তু আমার ছেলে হঠাৎ করে লম্বা হওয়ায় তার অন্যান্য বন্ধুরা প্রবেশের সুযোগ পেলেও সে এই গরমে তপ্ত দুপুরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয় গেটের বাইরে বা প্লে গ্রাউন্ডে যেখানে কোন ছায়া নেই। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে সে মাথা ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়ে। স্কুল ড্রেসের ব্যাচ দেখাতে বলেছিলাম ছেলেকে তখন নাকি গার্ডরা বলেছে যে সে ব্যাচ বানিয়ে এনেছে মেয়েদের ক্লাসের সময় স্কুলে ঢুকে মেয়ে দেখার জন্য। আমি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ছিলাম বারবার যে ক্লাস ফাইভে পড়া একটা ছেলেকে কিভাবে এমন কথা বলা হয়। আর সে কি এমন ক্ষতি করবে মেয়েদের! ক্ষতি করা বা উত্যক্ত করা যায় এমন শিক্ষা তো স্কুলের সিস্টেমই উপহার দিচ্ছে।

তারচেয়ে বড় ক্ষতি তো এই সিস্টেম করে দিচ্ছে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে। মেয়েদের সাথে মিশতে না পারা ছেলে গুলোর অদৌম কৌতুহল কি স্কুল গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মেয়েদের বের হওয়াটা কি এখন স্বাভাবিকভাবে দেখবে! তারা কি মেয়েদেরকে নিজেদের মত শুধু মানুষ ভাবা শিখবে! তারপর একদিন আমি গেলাম স্কুলে ছেলের সমস্যার সমাধান করতে। গিয়ে আমার অভিযোগ জানানোর সাথে সাথে তারা আকাশ থেকে পড়লো যেন। মেয়েদের ক্লাসের সময় ছেলেরা থাকবে সেখানে!!! এ এক সপ্তাশ্চার্য যেন। আমাকে বলা হলো আপনি কি চান ছেলে মেয়ে একসাথে ক্লাস করুক। আমি বললাম হ্যাঁ অবশ্যই চাই। আর এটা কি মাদ্রাসা যে এখানে মেয়েরা থাকলে ছেলেরা প্রবেশ করতে পারবে না। তখন অনেক কথা-কাটাকাটি হলো। তারপর প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে বলা হলো; যা আর হয়নি। আর হলেও কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না।

আমি শুধু অবাকই হই এ কোনদিকে যাচ্ছি আমরা! স্কুলে এ বছর থেকে দেখছি অনেক বাচ্চারা স্কুল ড্রেসের আদলে পাঞ্জাবি পরে আসা শুরু করেছে। পাঞ্জাবি অবশ্যই ভালো পোশাক আর পোশাকের স্বাধীনতাও থাকা উচিত। কিন্তু জায়গা বিশেষে বিশেষ পোশাকের বা কিছু নিয়মের আবশ্যকীয়তা আছে বৈকি। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি আমরা মানবিকতা, নৈতিকতা, আদবকায়দা, সামাজিকতা সবকিছুই তো শিখবে। সেটাই প্রকৃত শিক্ষা। আর তা যদি না-ই হয় ছোট চুল রাখতে হবে, ফ্যাশনেবল ইচ্ছেমতো ড্রেস পরা যাবে না, নখ রাখা যাবে না এমন নিয়মগুলো তো তাহলে স্কুলে রহিত করার সময় এসেছে তাহলে। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে সাম্প্রতিকদায়িকতা মুক্ত। ইউনিফর্ম দেয়ার উদ্দেশ্যই তো নিয়মানুবর্তিতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধনী গরীব বৈষম্য ইত্যাদি দূর করা। যখন তারা একসাথে একই ইউনিফর্ম পরে থাকবে তাদেরকে শুধু মানবশিশু মনে হবে। তার আর্থিক অবস্থা, ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র কিছুই দৃশ্যমান থাকবে না; বৈষম্য আর পক্ষপাত দূর হবে। সেখানে কেন বিশেষ ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা টেনে আনার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এখন যদি হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কোন ছাত্র তার ধর্মীয় পোশাকে স্কুলের লগো লাগিয়ে সেটা পরে ক্লাস করতে চাই সেই দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষ মেনে নেবেন তো?

আমার কাজিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে ঢাকার একটি নামকরা স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করছে। আমার বাসায় ছুটির দিনে বেড়াতে এলে তাকে থাকার অনুরোধ করার পরও সে থাকতে রাজি হলো না পরদিন স্কুলে যেতে হবে বলে। আমার বাসা থেকে স্কুলটি কাছেই তাই ইচ্ছে করলেই সকালে উঠেই যেতে পারতো। কিন্তু তার স্কুলে নারী শিক্ষকদের এপ্রোন পরে যাওয়া আবশ্যক, তাই এপ্রোন সাথে না থাকায় সে থাকলো না। আরও জেনে অবাক হলাম স্কুলে সব ম্যাডাম হিজাব পরে, আর ও পরে না, কিন্তু মাথায় কাপড় দিতে হয়। ক্লাস ফাইভে ক্লাস নেয়ার সময় মাথায় কাপড় না থাকায় তাকে নিয়ে স্কুলে বিচারও বসেছে। অথচ স্কুলটি ইংরেজি মাধ্যমের। আর স্কুলে ছেলেমেয়ে আলাদা ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও মেয়েদের স্কুল ড্রেসের ওপর বড় সাদা ওড়না পরা বাধ্যতামূলক। ক্লাস ফাইভে পড়া এক মেয়ের মা তার ছোট মেয়ে এতো বড় ওড়না সামলাতে পারবে না বলে প্রতিবাদ করায় তাকে অন্য স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সমস্ত গল্প শুনে খালি অবাক আর বিস্মিত হয়েছি। আমি কম্বাইন্ড স্কুলে পড়েও ভি ওড়না পরেই যেতে পেরেছি সেই ২০০০ সালে, কলেজ ড্রেসের সাথেও আলাদা বড় ওড়না পরিনি। আর এখন ক্লাস ফাইভের মেয়েকেও বড় ওড়না পরতে বাধ্য করা হচ্ছে, যেখানে সহপাঠী শুধু মেয়ে। এই পুরো প্রক্রিয়া আসলে কী শেখাচ্ছে!

নওগাঁর মহাদেবপুরে দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে হিজাব পরে আসায় ১৮ ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে সহকারী প্রধান শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। এই শিক্ষিকা নাকি ছাত্রীদের অপমান, মারধর ও অকথ্য গালিগালাজ করেছেন হিজাব পরার কারণে । ১৮ জন ছাত্রীকে মারধর করা আর গালি দিতে বেশ কিছুটা সময় লাগার কথা। সে সময়ের মধ্যে কেউ কি সে দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করেনি! যেভাবে হৃদয় মন্ডলের ক্লাস রেকর্ড করা হয়েছিলো! এখন তো সবার হাতে হাতে মোবাইল। নিউজগুলোতে শুধু দেখছি হিজাব পরায় মারধর করা হয়েছে এরকম কিছু কথাবার্তা লেখা। স্কুলই মেয়েদের বাধ্য করছে স্কুল ড্রেসের উপর বড় ওড়না বা এপ্রোন পরতে। সেটা নিয়ে তো এতো আলোচনা, প্রতিবাদ হয় না। কোন কারণে শিক্ষিকা মেয়েদের শাস্তি দিয়েছেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ এখনও কোথাও দেখতে পেলাম না। যদিও এরইমধ্যে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে যে পুরোটাই পূর্ব পরিকল্পনাপ্রসূত। ওই সহকারি প্রধানশিক্ষিকাকে ফাঁসানোর জন্যই এই গল্প ফাঁদা হয়েছে।  হিজাব পরা বা না পরা নয়, ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি দেয়া হয়েছে স্কুল ড্রেস না পরে স্কুলে আসার কারণে। কী আশ্চর্য! একটা স্কুলে নিয়মভঙ্গের জন্য শাস্তি পেতে পারবে না শিক্ষার্থীরা?

তবে অবশ্যই একজন শিক্ষক/শিক্ষিকা হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের মারধর করা বা অকথ্য গালিগালাজ করা উচিত নয়। আইন অনুযায়ীও নিষিদ্ধ। আর হিজাব পরার অধিকারও ছাত্রীর আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মারধর বা গালিগালাজকে ইস্যু না করে “হিজাব পরিহিতা” বিষয়টিই উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে হাইলাইট করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নামাজের আলাদা জায়গার জন্য আন্দোলন করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় মাকড়সার বিষ কত গভীরে পৌঁছে গেছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার সূতিকাগার। ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর নেতৃত্বে ছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প তাকে কোথায় নিয়ে এলো। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে গড়তে আন্দোলন করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে তাদের চাওয়া কেমন করে বদলে গেলো। তারা শিক্ষার মানোন্নয়, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধিসহ হাজারও মৌলিক চাহিদা রেখে টিএসসিতে নামাজের আলাদা জায়গা কেন চাইলো! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবনেই মেয়েদের আলাদা নামাজের জায়গা আছে, আছে কেন্দ্রীয় মসজিদ। একুশ শতকের মেয়েরা মসজিদে ছেলেদের সমান মেয়েদের জন্য জায়গা বরাদ্দের দাবি না করে টিএসসিতেই কেন নামাজের জায়গার দাবি করলো! কলাভবনের বিশাল বিল্ডিং এ মেয়েদের কমনরুম মাত্র দুটি; নিচ তলা আর চার তলায়। অন্যান্য ভবনেও একটি করে। অথচ ছেলেদের জন্য প্রতিটা ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে ওয়াশরুম আছে। মেয়েদের ওয়াশরুমের স্বল্পতার কারণে আর অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন হওয়া ছিলো সময়ের দাবি। যাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য চার তলায় দৌড়াতে না হয়, নোংরা ওয়াশরুম থেকে ইউটিআই না হয় বা পিরিয়ড ম্যানেজমেন্ট এর ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু এমন আন্দোলন তো হতে দেখছি না। আন্দোলনের বিষয় হচ্ছে নামাজের জায়গা দাবি, যেখানে সারা দেশ ভর্তি মসজিদ। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার আন্দোলন মেয়েরা করছে না। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যাদের এক ওয়াশরুম ইউজ করতে চার তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়, সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তারা কি নামাজের সময়ে টিএসসি থেকে হেঁটে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি বা কলা ভবন বা মসজিদ পর্যন্ত আসতে পারবে না! এও কি সম্ভব! নাকি এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য অন্য!

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র টিএসসিতে নামাজের জায়গার নামে সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ করার আরেকটা প্রক্রিয়ার শুরু। এখন যদি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ সব ধর্মাবলম্বী ছাত্রছাত্রীরা টিএসসিতে তাদের প্রার্থনার ব্যবস্থার দাবি করে তখন কি টিএসসিতে নামাজের জায়গার নামে মসজিদ আর অন্যান্যদের জন্য মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদি স্থাপন করা হবে? এই কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য! আমরা বোধহয় ভুলেই গেছি বিদ্যালয় আর প্রার্থণালয় এক নয় বা বিদ্যালয় ধর্ম প্রচারের জায়গা নয়। বিদ্যালয় অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সুনাগরিক গড়ার স্থান।

একটা সময় ছিলো যখন মাদ্রাসার নাম শুনলে সবাই নাক সিঁটকাতো। যখন গ্রেডিং সিস্টেম ছিলো না তখন ছোটবেলায় দেখেছি যারা এসএসসি পাশ করতে পারতো না তারা গিয়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিতো। কারণ তখনি পাশ করা অনেক কঠিন ছিলো। মাদ্রাসার সিলেভাস অপেক্ষাকৃত সহজ থাকায় সেখানে ভর্তি হয়ে পাশ করে যেতো। তখন মাদ্রাসাও ছিল খুব কম। কিন্তু আজ সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত মাদ্রাসা। আর এই সাম্প্রদায়িক মাকড়সার জালে আটকে পড়া অনেক শিক্ষিত ফ্যামিলির অভিভাবকগণ তাদের মেধাবী সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করছেন এখন। তাই ইদানিং পত্রিকার শিরোনাম হয় মাদ্রাসার ছাত্র ভর্তি পরীক্ষার অমুক ইউনিটে প্রথম তমুক ইউনিটে দ্বিতীয়। শিশুকাল থেকে তারা ধর্মশিক্ষার নামে যে সাম্প্রদায়িকতার চর্চার মধ্য দিয়ে আসছে তা তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেয়ার সাথে সাথে উবে যাবে না। শিল্প সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই আজ আমাদের নিজস্ব পোশাক, সংস্কৃতির চেয়ে বোরখার দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। টিএসসিতেই নামাজের জায়গার জন্য আন্দোলন হচ্ছে। এরপর হয়তো শুনবো ছেলে ও মেয়েদের আলাদা শিফটে ক্লাস করার জন্য আন্দোলন হচ্ছে। তারপর হয়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদ পরিবর্তন করে ইমাম পদের সৃষ্টি হবে। সেদিন বোধহয় খুব দূরে নেই। ঢাকার রাস্তায় আজ টিপ পরে চলা যায় না। কিছুদিন বাদে হিজাব হবে বাধ্যতামূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো হবে বিশ্বমাদ্রাসা টাইপ কিছু।

সারাবিশ্ব বিজ্ঞানের জয়জয়কার করছে আর আমার দেশে বিজ্ঞান শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে যাচ্ছেন জেলে। মন্ডল টাইটেল ধারী শিক্ষককে সাম্প্রদায়িকতার বিষ খুব সুপরিকল্পিত ও সুনিপুণভাবে জেলে পৌঁছে দিয়েছে। নওগাঁর শিক্ষিকাকে জেলে পাঠানো হলেও অবাক হবার কিছু নেই। এত ধর্মচর্চার বিকাশ অথচ আমাদের প্রতিবেশীরা সব কলকাতা মুখি। এত ধার্মিক অথচ রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম মেলানোর নানাবিধ চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ধর্ম অনেক দূরে থাকে। এতো ধার্মিকের দেশে আজ মানবতার বড় অভাব!

সাম্প্রদায়িকতার মাকড়সা তার বিষ ছড়িয়ে পুরো জাতিকে এমন অচেতন করে তুলেছে যে তারা টেরই পাচ্ছে না নিজেদের পায়ে কীভাবে নিজেরা কুড়াল মারছে। কীভাবে মেধাশূন্য হয়ে ক্রমান্বয়ে ছুটছে ধ্বংসের দিকে। মানবিক না হয়ে আমরা শুধুমাত্র মেধাহীন সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছি দিনদিন।

শেয়ার করুন: