শম্পা বণিক:
মানবদেহের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, চোখ, কান, নাক (শ্বাসনালী), দু’টি করে থাকলেও জিভ অথবা মুখ কিন্তু একটা। তার মানে একটা মুখে কখন, কোথায়, কতটুকু বলতে হবে তা সবার জানা প্রয়োজন।
আমাদের সমাজ তিনভাগে বিভক্ত:
প্রথম : যে করে (যে কার্য করে)
দ্বিতীয় : যাকে করা হয় (যাকে টার্গেট করা হয়)
তৃতীয় : চরম ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পায় নীরব দর্শক হয়ে।
ঠিক তেমনটিই কিন্তু হয়েছিলো গত রবিবারে হলিউডের ৯৪ তম অস্কার অনুষ্ঠানের মঞ্চে।
ক্রিস রক অনুষ্ঠান চলাকালীন কৌতুক করে কটাক্ষ করলো অভিনেতা উইল স্মিথের স্ত্রী জেডাকে নিয়ে, আর জনসমক্ষে উইল স্মিথ থপাস করে থাপ্পড় মেরে কটাক্ষের প্রতিবাদও করলো| কিন্তু প্রতিবাদের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তৃতীয় ভাগে বিভক্ত মানুষ কিন্তু দাঁতের হালি বের করে হাসছিলেন, এই হাসিটা হয়তো অক্ষত থাকতো যদি প্রতিবাদটা না হতো। প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হলেও কেউ কিন্তু প্রতিবাদ না করার পক্ষে বলেনি। কৌতুকের ছলে কটাক্ষ করে কাউকে আঘাত করাটা যতটা সহজ, তার চেয়ে পাহাড় সমান কঠিন তা নিতে পারা, আর তা যদি হয় পাবলিক মঞ্চে। এই প্রতিবাদের ভাষা যেমনি হোক, কিন্তু এরপর থেকে কারো সাফল্য বা দুর্বলতা নিয়ে কৌতুক ছলে কটাক্ষ করতে গিয়ে দু’বার ভাববে মানুষ, এটা নিশ্চিত। তবে আমাদের সমাজে বা আমাদের চারপাশের পরিবেশতো আর সেই লস অ্যাঞ্জেলেস-এর অস্কারের মঞ্চ নয়, যা নিরাপদ থাকবে অথবা উইল স্মিথের মত মানুষরা থাপ্পড়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলবেন, “ভালবাসা এবং দয়ার পৃথিবীতে সহিংসতার কোন স্থান নেই”।
সমাজে কাদের সংখ্যা বেশি? ধর্ষক নাকি দর্শক? দর্শকের সংখ্যাই বেশি। তবে অধিকাংশ দর্শকই যেহেতু মৌন, তাই ধর্ষকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে নির্ভয়ে। নারীদের জন্য পৃথিবী অনিরাপদ অনেকটাই, দেশে দেশে সমাজে সমাজে তার হার কম বেশি হতে পারে, তবে বিষয়টি সব জায়গার নারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল দুনিয়া তো আরো একধাপ এগিয়ে|
কিছুদিন আগে এক নারী সেলিব্রেটি যিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এক ভারতীয় নাগরিককে এবং সেজন্য অসংখ্যবার ইন্টারনেটের মাধ্যমে হ্যারাস হতে হয়েছে বা হচ্ছে সেই নারীকে। একদিন তার একটি স্বাভাবিক শাড়ি পরা একটা পোস্টে আমি একটি পজিটিভ লাইন লিখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বেশকিছু মানুষ আমাকে ধুয়ে দিলেন, কেন আমি সেই নারীকে সাপোর্ট করছি? আমার ফেইসবুকের সব পাবলিক ছবি স্ক্যান করে আমাকে বুলিং করা শুরু হলো, তারপর আমার ধর্মকেও জড়ালো- আর এই সবকিছুর জন্য সময় নিয়েছিল মাত্র ৩ মিনিট, খুব দ্রুততার সাথে ঘটে গেলো এই কাজটি। নিজের মানসিক সুস্থতার জন্য আমি পরে আমার কমেন্টটা ডিলিট করতে বাধ্য হই। গত সপ্তাহে সেই নারী অভিনেত্রীকে আক্ষেপ করে একটি সাক্ষাৎকারে বলতে শুনলাম, “আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি সাইবার বুলিং হয়, কিন্তু কেউ কি তা দেখে বা প্রতিবাদ করে”?
আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন আমি তার পাশে দাঁড়াতে পারিনি বলে। নিজের মানসিক সুস্থতার কথা ভাবলাম, কিন্তু তার কথা কেন ভাবলাম না, যে প্রতিদিন মিলিয়ন কমেন্টের ৯৯ শতাংশ গালি নিয়ে দিনের শুরু বা শেষ করে। সাইবার দুনিয়া কী ভয়াবহ তা আমি মাত্র তিন মিনিটেই অনুধাবন করেছিলাম সেদিন।
ধর্মীয় সভা পর্যন্ত গালিবিহীন জমে না,
ঘটনা যাই হোক খুব খারাপ একটা কথা লিখা বা বলা যেন কোন ব্যাপারই না। কারণ সে তো নারীই, তাকে গালি বা বুলিং না করলে যে পৌরুষটা দেখানো হবে না। হোক না সে সুফিয়া কামালের মত কোন পথপ্রদর্শক নারী|
অথবা সেই ইভটিজিঙ-এর শিকার নারী (কাজী জেবুন্নেছা জামান), বাসে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে কী দেখলাম? পুরা বাসে দুইটি মানুষও তার জন্য দাঁড়ায়নি, ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিল সবাই, যেন তার পর কী হয় দেখি!
গত ১৩ই মার্চ বাংলাদেশ জুয়েলারী মালিক সমিতির একটি অনুষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষিত ও সচেতন লোককে দেখলাম হুমড়ি খেয়ে তাদের সভাপতির সাথে ক্লোজআপ মার্কা হাসি দিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছে, অথচ এই সভাপতির নামে একটা মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে মামলা চলছে। ধরে নিলাম রাষ্ট্র সেই মৃত কলেজ ছাত্রীর পক্ষে বিচার করতে পারেনি, ধরে নিলাম আমি অথবা আপনিও নীরব দর্শক হয়ে বিচার চাইতে পারলাম না, অন্তত বয়কট তো করতে পারতাম? যে ব্যক্তি একজন নারীকে অসম্মান করলো, তার সাথে ছবি দিয়ে আপনি আপনার ইমেজ বাড়ালেন? কামঅন ম্যান! আমাদের আশেপাশে এদের মতো অনেক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এদের গলা জড়িয়ে ধরা ছবি পোস্ট করার আগে ভাবুন কাকে আস্কারা দিচ্ছেন।
চারপাশে যাই হোক আমরা মনুষ্যত্ব ভুলে গেছি, ভুলে গেছি প্রতিবাদ করতে, ভুলে যাই আমিও এই সমাজের অংশ। অন্যায়কারীকে প্রতিহত বা প্রত্যাখ্যান না করলে একদিন এই বিষাক্ত পরিবেশের জন্য আমরা দর্শকরাই দায়ী থাকবো। সাইবার বুলিং, অসম্মানজনক কৌতুক, ইভটিজিং এবং ধর্ষণ, সব রকমের অন্যায়কারীকে বয়কট করুন- এটাই হওয়া উচিত আপনার বিবেকের কাজ, সঠিক কাজ।
না, থাপ্পড়কে সমর্থন করছি না- কিন্তু প্রতিবাদটাকে পুরাপুরি সমর্থন করছি। এটার প্রয়োজন আছে সভ্যতার বিপরীতে চলা মানুষের জন্য। সেইসাথে উইল স্মিথের মত করে বলি “ভালবাসা এবং দয়ার পৃথিবীতে সহিংসতার কোন স্থান নেই”। নারীবান্ধব হোক পৃথিবী ও ভার্চুয়াল জগৎ,
“জিরো টলারেন্স’ হোক নারীর বিরুদ্ধে ছোঁড়া সকল অসম্মানজনক তীরের প্রতি।
ওয়াশিংটন ডিসি (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে।