শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সেইসব দিনগুলি!

সাজু বিশ্বাস:

অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। কিন্তু এতেই সবাই ভালো হয়ে যাবে, এমন আশা করার কোনো কারণ নেই। বিশেষত টিপ পরা নিয়ে সংসদে কথা বলার জন্য সুবর্ণা মুস্তাফাকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেভাবে গালাগালি করছেন, তা দেখে একটা কথাই খালি মনে হচ্ছে গলদ হলো আমাদের শিক্ষায়।

প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকবে, প্রত্যেকে তার পছন্দ মতন সাজ পোশাক পরিধান করবে — আলাদা আলাদা ধর্ম থাকবে, আলাদা আলাদা সংস্কৃতি থাকবে…. এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করে চলতে হবে, এই সুশিক্ষা আমাদের নেই। আমাদের মধ্যে যারা একটু বেশি ধর্মপরায়ণ, তাঁরা মনে করেন আমি যেমনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি, এতো জোরে জোরে আর কেউ ডাকতে পারে না। আমার মতন যারা, তারা ঠিকাছে। কিন্তু বাকিরা সব ঘোরতর পাপী। এরপর তারা নিজের জাগতিক দায়িত্ব মনুষ্যত্ব সব ভুলে নিজের কায়দায় সমাজ সংস্কার করতে লেগে পড়েন।

মূলতঃ পৃথিবীর বাকি মানুষদের সংস্কৃতি জীবন এবং বাকি জগত সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে যাওয়াই আমাদের এই দীনতার কারণ। আমরা বড় পূণ্যবান…. এই মোহ চিন্তা আমাদেরকে বাকি দুনিয়াদারি এবং মানুষদের থেকে ক্রমশই দূরে সরিয়ে দেয়। ক্রমশঃ নিজের গণ্ডির বাইরের কাউকে দেখলে তাকে সন্দেহজনক মনে হতে থাকে! বিরক্তিকর বা তুচ্ছ বা ঘৃণার পাত্র মনে হতে থাকে। সহজ মানুষ ভজার দিন শেষ হয়ে গেছে আমাদের সমাজ থেকে। ঢোল করতালের দিন শেষ হয়ে গেছে। খালি পায়ে গামছা কাঁধে হাঁটার দিন শেষ হয়ে গেছে। নারীকে দেখে সম্মানের সাথে মা-বোন বলে আগের কাতারে পথ করে দেবার দিন শেষ হয়ে গেছে।

সুবর্ণা মুস্তাফার কথা বলি।
আমার মাঝে মাঝে নিউজ ফিড পড়তে গিয়ে মনে হয়, ছোটবেলায় স্কুলে যাবার পথে স্কুলের পাশের দোকানগুলোতে যে বখাটে ছেলেগুলোকে দেখতাম, যারা সারাদিন অক্লান্তভাবে দোকানগুলোতে বসে রসগোল্লার মতন বড় বড় চোখ মেলে স্কুলগামী মেয়েদের দেখতো আর মাঝে মাঝে টুকটাক মন্তব্য ছুঁড়তো…. তারাই এখন নিউজ দেখলে কমেন্ট করতে চলে আসে। সস্তা মোবাইল আর নেটের যুগে এখন রাস্তার মোড়ে না বসলেও চলে।

সুবর্ণা মুস্তাফার কাছে ফিরে যাই।

সুবর্ণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এম এ। এইকথা এই দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে না। কিন্তু সুবর্ণা নাটক করেন। তিনি দুইটা বিয়ে করেছেন, নিজের হাঁটুর বয়সী ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, এই কথা দেশের ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সমস্ত পুরুষ জানেন। কারণ এইসব কথা জানলে কাউকে গালাগালি দিতে সুবিধে হয়। নাটকের মানুষ সংসদে কী করে! সংসদ অপবিত্র করে ফেললো… এ কেমনে সেখানে ঢুকলো… আরো কত যে মন্তব্য! পড়তে পড়তে বমি আসে…।

সুবর্ণা নিজের জীবন সম্পর্কে বলছিলেন,– আমার জীবন, আমি আমার পছন্দ মতন কাটাতে চাই।
একজন মানুষের মতন কথা। এই দেশের অধিকাংশ নারীই নিজেকে মানুষ ভাবে না। নারী ভেবে নিয়েই জীবন পার করে দেয়। সুবর্ণা তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট একজন পুরুষকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছেন। এটাই তার অপরাধ। তিনি নাটকের খারাপ নারী।
অথচ কোনো কোনো মহাপুরুষ চুরি করে তৃতীয় পক্ষ সাথে নিয়ে হোটেলে অবকাশ যাপনে গিয়ে ধরা পড়লেও তিনি সেই অর্থে চরিত্রহীন নন।
পুরুষ মানুষের এটা চলতেই পারে। নারী হইলেই বিরাট বদ! বিরাট খারাপ।
তো এই কমেন্টকারী মানুষেরাই এখন সবজায়গায় বেশি শক্তিশালী। এরা পথেঘাটে বাজারে বা নেটে মেয়ে মানুষ দেখলেই নিজের মনের মধ্যে আগে একখানা বিচার সভা বসায়ে নেন। স্লিভলেস পরা মেয়ে – নষ্টা। শাড়ি পরা মেয়ে – মাল। টাইট জামাকাপড় পরা মেয়ে — বাজারের মেয়ে! নিজে কী! নিজের জন্য তো কনফিডেন্স তোলাই রয়েছে। নিজে বিরাট সদাশয় ধার্মিক। এরপরই তাদের মগজ থেকে ঘৃণা ছুটতে শুরু করে!
কোনো মেয়েই ভালো নয়। কেউ ভালো নয়।
মেয়ে অতি তুচ্ছ নিকৃষ্ট জিনিস।

সামনে বাঙালির পহেলা বৈশাখ আসছে।
একটু আগে ঢাকা ট্রিবিউনের পেজে দেখে এলাম পহেলা বৈশাখের আয়োজন শুরু করেছে চারুকলা। এই খবরের নীচে এসে মানুষ গালাগালি করছে। কতবার কতভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে পহেলা বৈশাখ কোনো পার্টিকুলার জাতিধর্মের উৎসব নয়! অনেক ধর্ম এবং জাতির মধ্যেই আগে থেকে সূর্য নিয়মে সংবৎসর গণনার একটা নিয়ম প্রচলিত ছিল। সমস্ত হিসেবনিকেশ মাথায় রেখে সম্রাট আকবর বাঙালির পহেলা বৈশাখটি তারিখ গণনার জন্য প্রচলন করেছিলেন। এটি বাংলার সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর একটি মিলিত উৎসব। কিন্তু এই সকল বোঝানোর প্রচেষ্টা জলে গেছে। মানুষের গালাগালি দেখলে বোঝা যায় সংস্কৃতি ভাবার চেয়ে পাপপূণ্য নিয়ে ভাবিত বেশি সবাই।

সবিশেষ, আজ ডিমের হালি কিনেছি ষাট টাকায়।
এগারোটা বা বারোটায় কলার ছড়া। এক ছড়া কলার দাম নব্বই টাকা। সে এমনভাবে নব্বই টাকা বললো, আমার মনে হলো লজ্জায় পালিয়ে বাঁচি!
অথচ, আমি বেশ মোটামুটি একটা চাকরি করি।
যারা রিকশা চালায়, যারা দিনমজুরি দেয়, ওরা কেমন করে জীবন কাটাচ্ছে কী জানি!

আমার এক পরিচিত লোক আজ বলছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের ছোট ছোট দুর্নীতিও সহজে কারো চোখ এড়ায় না। অথচ সব সরকারি চাকরিজীবী কিন্তু দুর্নীতিবাজ নয়। কিন্তু ছোট-বড় ছিঁচকে সিঁধেল সব ধরনের ব্যবসায়ীরাই দুর্নীতিবাজ। এদের কথা কেউ বলে না। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসে, এতো এতো যে ভালমানুষ সবাই, এতো যে ধার্মিক সবাই — কই এইসব নিয়ে তো গালাগালি করেন না! কোথায় কোন মেয়ে টিপ পরে রাস্তায় হাঁটলো… কেন সুবর্ণা, দুই বিয়াইত্ত্যা মেয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে ইভটিজিং নিয়ে কথা বললো! কেন পহেলা বৈশাখ আসে! এই নিয়ে দেশ সরগরম।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.