শাড়ি-চুড়ি-টিপ আমার সংস্কৃতি

সাবরিনা স সেঁজুতি:

আমার আগে পরে একটাই পরিচয়, আমি বাঙালী। সেটা আপনাদের ভালো লাগুক আর না লাগুক। আমি জন্মেছি বাংলায়, বাঙ্গালীয়ানাই আমাকে মানায়। তাতে আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক।

অযথা ধর্মের বেড়াজালে আমি কোনদিন বাঁধা পড়িনি, পড়বোও না। তাতে আপনি আমাকে শাহাবাগী বলেন, জাহান্নামী বলে আশীর্বাদ করেন, সে আপনার ইচ্ছা। আমার কপালের টিপ যদি আপনার গাত্রদাহের কারণ হয়, তাতে যদি আপনার ধর্ম বস্ত্রহীন হয়, সে দায় আমার বাঙ্গালীয়ানার নয়। বরং একটু চেষ্টাচরিত করে দেখুন আপনার ঠুনকো ধর্মের বড়াইটাকে কোনভাবে শক্তপোক্ত করা যায় কি না!
যুগে যুগে জায়গাভেদে সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ধর্মগুলো তাদের চাল চলন বদলেছে। ধর্মগুরুরাও জানেন ধর্মের দোহাই দিয়ে একটি জাতির সংস্কৃতি বদলে দেয়ার মতো বোকামি আর কিছু নাই। কেননা সংস্কৃতিহীন জাতি আর মৃত দেহের মধ্যে পার্থক্য সামন্যই। মৃতের কোন ধর্ম নাই।

আমি বুঝি, আপনিও বদলেছেন। নিজের প্রয়োজনে, অতি চালাকের মতো আপনি আপনার ধর্মের হাল চাল আলতো করে বদলে ফেলেছেন। এই যেমন ধরুন, ধর্ম আপনাকে বলে দান করুন, লোকের সেবা করুন। কুরবানী দিন, গরীবকে সহায়তা করুন। আপনি কী করেছে?- দান করেছেন কম, করুণা করেছেন বেশি। সেবা করেছেন কম, লোক দেখানো সাহায্য করেছেন বেশি। কুরবানীর ত্যাগ কম, অহংকার বেশি। এই আর কয়েক মাস পর আপনার সামাজিক মাধ্যম ভরে যাবে লাখ লাখ টাকার গরুর ছবিতে। তখন আপনার ধর্ম বস্ত্রহীন হয় না। আপনার ধর্ম কেবল বস্ত্রহীন হয় নারীর বব কাট চুল, কপালের টিপ আর ওয়েস্টার্ন পোশাকে। আপনি ভুলে গেছেন যে ধর্মের বড়াই আপনাকে দেমাগী করেছে বেশি, মানুষ করেছে কম। তাইতো হজ্জ যাত্রা আপনার কাছে আর ইবাদত নয়, পাপমোচনের শর্টকাট। তাইতো, যার যতো পাপ তার হজ্জ করার তাগিদ তত বেশি।

অন্যদিকে আমার বাঙ্গালীয়ানা আমাকে আমার শেকড় চেনায়, প্রশান্তি দেয়, ভালোবাসতে শেখায়। আর সেকারণেই আমি পথেঘাটে লোক থামিয়ে বলি না, “ভাই দেড় লাখ টাকার গরুটা যে কিনলেন, নিয়ত কী?” হজ্জে যে যাচ্ছেন, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নাকি লোক দেখানো?

আপনি যখন সকাল-বিকাল নিজের প্রয়োজনে আপনার প্রাণ প্রিয় রাসুলের ধর্মের বলাৎকার করেন, তখন বাড়িতে ফিরে ভুলেও কি আয়না দেখেন না? আয়নাটি যদিওবা দেখেন নিজেকে প্রশ্ন করেন কি, সারাদিন কী কী করেছেন আর কেন করেছেন? নিজের প্রতিবিম্ব আয়নায় দেখায় সময় বোধ করি আপনার নাই কারণ আপনি তো ব্যস্ত আমার কপালের টিপ নিয়ে, আপনি তো ব্যস্ত আমাকে হেনস্তা করতে। সেটাই বুঝি আপনার ধর্মশিক্ষা?

বাংলার মাটিতে দাড়িয়ে আপনি নিজের শেকড় ভুলে উদ্ভ্রান্তের মতো আমাকে তাড়া করছেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। আপনি ভুলে গেছেন আপনি যে দেশের আলো-বাতাসে লালিত পালিত, দেশটির নাম বাংলাদেশ। দেশটি আমাদের, বাঙ্গালীদের। শাড়ি-চুড়ি-টিপ আমার সংস্কৃতি। আমি আপনাকে আপনার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেই তার মানে এই নয় আপনি আমার সংস্কৃতি পালনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবেন। আমার সংস্কৃতি হয়তো আমাকে আঘাত করতে শেখায় না কিন্তু ইতিহাস ঘেটে দেখুন আমার সংস্কৃতি আমাকে আত্মরক্ষা করতে শেখায় বটে।

সাবরিনা স সেঁজুতি
অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির সেশনাল শিক্ষক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.