বাঙালী নারীর পরিচয় ‘টিপ’

পূর্ণাশা অরোরা:

ছোটবেলা থেকে শাড়ি পরলে টিপ না পরে থাকতে পারি না। মায়েরা অথবা বড় বোনেরা এখনও শাড়ি পরলেই টিপ পরিয়ে দেয় সাথে। তারাও শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ পরলে সবসময় সাথে টিপ পরে। এজন্য আমাদের বাসার মেয়েদের প্রায়‌ই শুনতে হয়, “তুমি কি হিন্দু? এতো বড় টিপ পরো যে!” আমি বুঝি না, টিপ পরলে আমার চেহারায় ধর্মের ছাপ কোথায় ফুটে ওঠে? ভালো লাগে তাই টিপ পরি, নিজের চেহারায় ধর্ম দেখাতে তো পরি না!

লতা সমাদ্দারের টিপ পরায় যে মন্তব্য শোনা লেগেছে, এমন অভিজ্ঞতা এদেশের অনেকের‌ই রয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ‌ও চলছে। কেবল নারী নয়, পুরুষেরাও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। টিপ কোনো ধর্মকে নির্দেশ করে না, বলা যায় বাঙালি নারীর সংস্কৃতি টিপ পরা। কাজল দিয়ে হোক, সিঁদুর দিয়ে হোক টিপ পরা বাঙালি নারীর পরিচয়। কোনো বিদেশি মানুষ যখন বাঙালির সাজ নেয়, তারা টিপ পরে। এতো বছরের পরিচয় নষ্ট করে ফেলা কি এতো সহজ কথা নাকি?

ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার এদেশের কিছু মানুষের মগজ কুঁড়ে খেয়েছে। তাদের ভেতর অন্য ধর্মের প্রতি, অন্য সংস্কৃতির প্রতি এতোটা বিদ্বেষ, যে তারা হিংস্র আচরণ করতে পিছপা হয় না। তারা যে খুব তাদের ধর্ম যথাযথ ভাবে পালন করছে, তাও কিন্তু নয়। কেবল ধর্মের নাম ব্যবহার করে অন্যকে উত্যক্ত করছেন। মুখে ধর্মের নাম নিয়ে তাদের অমানুষ হবার পরিচয় দিচ্ছে। এগুলোকেই বলে উগ্রবাদ। টিপের মত স্বাভাবিক ও harmless জিনিস যদি কারোর ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে, তবে সমস্যাটা তার ব্যক্তিগত। তার insecure স্বত্তা অন্যের পরিচয় নিতে পারেনা, অন্যের স্বাধীনতা দেখতে পারে না।

২০০১ সালের ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় দেখা গিয়েছিল এদেশের ধর্মান্ধতা কতটা প্রকট। পহেলা বৈশাখ উদযাপন বাঙালির ঐতিহ্য, এটাকে “হিন্দুয়ানি” বলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এতো এতো মানুষের প্রাণনাশের চেষ্টা করলো, তখন তাদের ধর্ম তাদের বাধা দেয়নি? ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা, তা‌ নিয়েও আপত্তি উগ্রবাদীদের। গত কয়েক বছর যাবত মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করতেও তারা নানান আক্রমনাত্মক আচরণ দেখিয়েছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে তো কারোর বাধা নেই, সকল ধর্ম সকল বর্ণ সকল জাতি মিলেই এই উৎসব পালন করে, কাউকে তো এ উৎসব পালন করে আঘাত করা হচ্ছে না, তাহলে এতো হিংস্রতা আসে কোত্থেকে? এই হিংস্রতা বেড়ে এখন একজনের কপালে টিপ দেখলেও তাদের কলুষিত মন আঘাতপ্রাপ্ত হয়। টিপ দেখে কারোর ধর্মে আঘাত লাগলে কতটা ভঙ্গুর তার বিশ্বাস? কিসের গর্ব তার তাহলে?

লতা সমাদ্দারের ঘটনা নিয়ে বহু মানুষ বহু প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাতে ধর্মান্ধদের প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ! তারা এই প্রতিবাদের জবাবে কোনো যুক্তিযুক্ত কথা বলতে না পারায় আক্রমণ করছে কুরুচিপূর্ণ অশ্লীল আচরণ করে। একটা সুস্থ প্রতিবাদের বিরুদ্ধে যখন তারা এমন অশোভন আচরণকে বেছে নিচ্ছে, তাতেই বোঝা যায় তাদের মানসিকতা কেমন, তাদের ধর্মান্ধতা কতটা প্রকট। সুবর্ণা মুস্তাফা সংসদে এই বিষয়টি তোলায় এই ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা তাদের ধর্মের নানান অজুহাত দেখিয়ে ফের অশোভন আচরণের দিকেই আগাচ্ছে। তাঁর অভিনয়ের পেশা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা, ব্যক্তিগত জীবন সব নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য রাখছে তারা। অনেকে এমন‌ও বলছে এসব ছোটখাটো ব্যাপার, সংসদে তুলবার মত নয়, তারা এটুকু বুঝছে না এটা একটা সংস্কৃতির ওপর আঘাত, নারীর নিরাপত্তায় আঘাত। একজন নারী হাঁটতে চলতে কিভাবে harass হচ্ছে তারা তা দেখছে না, বরং harassment টাকেই সাপোর্ট জানাচ্ছে। নারীকে আটকে রাখার জন্য যত রকম চেষ্টা তারা সব করছে, মাঝে ধার্মিক সেজে নিজেকে বুঝ দিচ্ছে যে তারাই ঠিক।

দেশের অধিকাংশ মানুষের চিন্তাধারা আজ এমন‌ই যে নারীদের বেশি অধিকার দিতে নেই, তারা ঘরে বন্ধ থাকবে, ঘরেও অধিকার পাবেনা, তাতেই তাদের জীবন পরিপূর্ণ হবে। যেসব নারী বাইরে কাজ করে, স্বাধীনভাবে চলবার সাহস রাখে তাদের সাথে harassment হ‌ওয়াটাই স্বাভাবিক। এদেশের যে আলাদা একটা সংস্কৃতি রয়েছে তাও তারা ধ্বংস করতে চায়। বাঙালির পরিচয়, উৎসব, আয়োজন সবকিছুকে দমিয়ে রাখতে প্রতিহিংসার পথ ধরে। তবে এদের হিংসাকে আমরা ছাড় দিতে পারিনা। তারা যত বাধা দেবে আমরা তত‌ই জোরে সোরে নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষায় এগিয়ে যাবো। ছায়ানট যেমন দমে না গিয়ে প্রতি বছর আরো বড় করে বর্ষবরণ আয়োজন করেছে, আমরাও তেমন দমে না গিয়ে টিপ পরবো। আমরা শাড়ি পরবো, চুড়ি পরবো, কাজল দেবো, টিপ পরবো। এটা আমাদের পরিচয়, এটা আমাদের সৌন্দর্য। আমাদের বাঙালি হবার পরিচয়, আমাদের শিকড়ের পরিচয়, আমাদের সাহস ও শক্তির পরিচয়। কোনো ধর্মান্ধতার কাছে আমরা হারবো না, আমাদের কপালের টিপ হবে আমাদের অস্ত্র।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.